
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি উপজেলা। এর দক্ষিণে বনযোগীছড়া ইউনিয়নের চকপতিঘাট গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। যাতায়াতের মাধ্যম ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নৌকা থেকেই নেমে চকপতিঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এক পাশে ছোট একটি বাজার। দোকানের সংখ্যা ২০টি। বাজারে ঢুকতেই কানে বাজে সেলাই মেশিনের খ্যাচ খ্যাচ শব্দ। কাছে গিয়ে দেখা গেল ছোট্ট একটি কক্ষে কাপড় সেলাই করছেন দুই নারী। একজন বাসনা চাকমা (৩৬) অন্যজন সবিতা চাকমা (৪০)।
তাদের সাথে কথা বলতে চাইলেও সময় দিতে পারেননি। একের পর এক বিভিন্নজন সেলাই কাজ নিয়ে আসছেন আর যাচ্ছেন। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকি।
সুযোগ মিলল কথা হলো বাসনা চাকমার সাথে। ২০০১ সালে তার স্বামী মৃন্ময় চাকমা লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান। অভাবের সংসার। দিন আনা দিন খাওয়া। একদিন চলার মতো অর্থও মজুদ থাকত না স্বামী হারা বসনা চাকমার ঘরে। সে সময় তার একমাত্র মেয়ে এশার বয়স ৬ বছর। প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। এরপর জীবন বাঁচাতে কখনো দিন মজুর-কখনোবা মানুষের ঘরে ঘরে কাজ করতে হয়েছে বাসনাকে। কিন্তু চরম অর্থকষ্টেও মেয়ের লেখা-পড়া বন্ধ হতে দেননি সে।
স্বাধীনভাবে কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় আসে বাসনার। প্রথমে এক সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন ক্রয়, দেকান ভাড়া ও মালামাল (কাপড়) কেনার জন্য বিভিন্ন ঋণদাতা অফিসে দিনের পর দিন ঘুরতে থাকেন। কেউবা দিন ক্ষেপণ আবার কেউ বড় বড় শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এতে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।
২০১০ সালে সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৪০ দিন দৈনিক ২০০ টাকা করে কাজ করার সুযোগ হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দৈনিক পাওয়া মজুরি থেকে অর্ধেক অর্থাৎ ১০০ টাকা করে সঞ্চয় শুরু করেন। কর্মসূচি শেষে জমানো টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন এবং ধারদেনা করে ছোট্ট একটি দোকানঘর ভাড়া নেন। কাজ শুরু করার পর রোজ ৫০০/৭০০ টাকা আয় হতে থাকে। এতে খুব দ্রুতই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। কাজে উৎসাহিত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে একটি সেলাইমেশিন উপহার দেওয়া হয়। ১০ বছর পর মেয়ে এশা চাকমা রাঙামাটি সরকারি কলেজের অনার্সের ছাত্রী। এছাড়া ভাড়া করা দোকানটিও কিনে নেন বাসনা। দোকানে একজন বেকার নারীকে কাজ দেওয়া হয়। এখন তার স্বপ্ন জেলায় নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ ও বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করা ।
একই স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে একই ইউনিয়নের ধামাইপাড়া কিয়াং বাজারের রিতা চাকমা (৩৭)। ২০০৮ সালে স্বামীর সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর সেনাবাহিনী পরিচালিত সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু করেন। রিতাও আজ স্বাবলম্বী। রিতা এখন তার মতো অবহেলিত-নির্যাতিত নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চাইছেন। সফলও হয়েছেন। যে-ই সাহায্যের জন্য আসুক, রিতা মুক্তহস্ত। সাবইকে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবার পরামর্শ দেন।
বাসনা এবং রিতাকে দেখে মিতা, রূপা ও কোহেলী চাকমাও নিজেদের ভাগ্য গড়ার সংগ্রামে নেমেছেন। সবার মুখে একই স্লোগান মেয়েরাও পারে শ্রমের বিনিময়ে ভাগ্য বদলাতে।
সুমন্ত চাকমা : ইনফোলিডার, জুরাছড়ি ইউডিসি, জুরাছড়ি, রাঙামাটি
protik/mohin
মন্তব্য (০)