হাসেম সরদারের নারকেল বাগান এখন মরণতলা

প্রতীক মাহমুদ : ইনফোলিডার, ইউডিসি, নকলা, পিরোজপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৬-০৬ ১৬:২০:২৯


morontola
morontola

ঊনিশো একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর। গণহত্যা চলছে সারা বাংলায়। খুলনায়ও হত্যা করা হচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিচারে। ঘটনাস্থল শাহপুর গ্রামের হাসেম আলী সরদারের নারকেল বাগান। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে এবং জেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে। খুলনার দৌলতপুর থেকে শলুয়া-থুকড়া থেকে শোলগাতিয়া অভিমুখে যে পাকা রাস্তা গেছে, তারই এক পাশে শাহপুর গ্রাম। গ্রামের বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে হাসেম আলী সরদারের নারকেল বাগান। অগ্রাহয়ণ মাস। ইংরেজি নভেম্বর। প্রচ- শীত তখন। দুই-একজন মুক্তিযোদ্ধা এলাকায় এসেছেন কোথাও কোথাও। এমনি সময় খবর পাওয়া যায় শাহপুরে আসবে খুলনা জেলার পিস কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আব্দুল আহাদ খান। যার বাড়ি পাশের ইউনিয়ন রুদাঘরায়। আসবে জেলার পিস কমিটির সেক্রেটারি মওলা বক্স গোলদার। তারও বাড়ি ডুমুরিয়া থানার শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রামে। আসবে পাশের ফুলতলা থানার আলবদরের সাব জুডিশিয়াল কমান্ডার হাবিবুল্লাহ হক। প্রচার করা হয়েছিল সবুর খানও আসবেন। তবে তার দেখা পাওয়া যায়নি। গ্রামবাসীকে আগামী দিন মিছিলসহকারে জনসভায় যাওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হলো। বিশেষ করে যে সকল হিন্দু ইয়াহিয়ার মিষ্টি ভাষণে ভুলে ভারত থেকে আবার বাড়ি ফিরে এসেছে তাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে চাপ দেওয়া হয়। এই শাহপুর গ্রামে তখনও কোনো রাজাকার আসেনি। পরবর্তী সময়ে মাত্র তিনজন রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিল শাহপুর গ্রামের- তারা হলো ১) ছাত্তার বিশ্বাস, ২) মতলেব সরদার ও ৩) আকব্বার মোল্যা। তারা মিকশিমিল রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান নিলে পরদিন মুক্তিযোদ্ধা মজিদ বাহিনীর আক্রমণে মারা যায়। শাহপুর ক্যাম্পে থাকতো রুদঘরা ও ধামালিয়ার নওশের বিশ্বাস, জোনাব আলি, নূর মোহাম্মাদ, মতিয়ার, আলতাফ গাইন নামে কয়েকজন রাজাকার। যথারীতি সকালে মিছিল হলো। মিটিং হওয়ার কথা শাহপুর গরুর হাটে। কিন্তু মিলিটারি, রাজাকার ও নেতারা শাহপুরের রহমান বিশ্বাসের খেজুর বাগানে অবস্থান নেয়। হাবিবুল্লাহ হক সবার উদ্দেশে বললো, ‘আমরা একটু ইন্ডিয়ান খবর শুনতে চাই। যে সকল হিন্দু ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসেছে আমরা তাদের কাছে জানতে চাইবোÑ তারা ইন্ডিয়ায় কেমন ছিল। কতটা শান্তিতে ছিল। কেনেই তারা ফিরে এলো।’ ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসা হিন্দুরা হাত তুললো। সাথে সাথে তাদের স্টেজের পাশে যেতে বলা হলো। সেখানে যাওয়া মাত্র বেঁধে ফেলা হলো তাদের। কাছেই ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের কিছু সেনা। তারা তাদের নিয়ে শাহপুর বাজারের দিকে রওনা হয়। হাসেম আলী সরদারের নারকেল বাগানের ধারে এলে তাদের দাঁড় করিয়ে দুটো গুলি করে চলে যায়। সবাই ঢলে পড়ে। তাদের মধ্যে ছিলেন ১) পঞ্চানন কু-ু, পিতা-দেবেন্দ্রনাথ, ২) নকুল রিশি ও ৩) অবিনাশ রিশি, উভয়ের পিতা-ঠাকুর দাস, ৪) জ্যোতিন্দ্র ম-ল,  (আন্দুলিয়া), ৫) নলিনীকান্ত রাজবংশী (ধীবর সম্প্রদায়ের লোক) ও ৬) সাখিচরণ রাজবংশী, উভয়ের পিতা-ক্ষিদির, ৭) দেবশুল ৮) গুরুপদ (১৪) ও ৯) অনাথ ম-ল, পিত-পাচো ম-ল এবং ১০) মান্দার বিশ্বাস, পিতা-শ্রীদাম বিশ্বাস। খানেরা গুলি করে চলে যাওয়ার পর অনেকেই তখনও বেঁচে ছিল। কেউ কেউ জল জল বলে চিৎকার করছিল। পাশের বাড়ির লোক তা শুনতে পেয়ে গোপনে পানি দেয়। ৮ বছরের শিশু দেবগুল চিৎকার দিয়ে ওর মৃত বাবার কাছে জল চাইছিল, বলছিল- ‘বাবা, আমারে একটু জল দাও।’ ‘মালাউনের বাচ্চারা জল চাচ্ছে বলে খবর দেওয়া হয় শাহাপুর বাজারমুখো যাওয়া রাজাকারদের। অমনি তারা এসে যথেচ্ছা বেওনেট দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত ও গুলি করে চলে যায়। এই গুলি ও বেওনেটের খোঁচা খেয়েও বেঁচে ছিল অবিনাথ রিশি। ক্ষতের যন্ত্রণা সইতে না পেরে একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে অবিনাশ ।

গুলির পর লাশ নিতে কেউ সাহস পায়নি। পরদিন পায়ে দড়ি বেঁধে খালে ফেলে টানতে টানতে বহু দূরে ওয়াপদার বাঁধ পার করে লাশগুলো নদীর চরে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে জোয়ারের জলে ভেসে লাশগুলো অন্যত্র চলে যায়। হাসেম আলী সরদারের নারকেল বাগান এ প্রজন্মের মানুষ চেনে না। একাত্তরের গণহত্যা ঘটনাস্থল হাসেম আলী সরদারের এই নারকেল বাগানের নাম এখনকার মানুষ জানে না। জায়গাটির এখনকার  নাম হয়েছে ‘মরণতলা’।

ঘটনার পর নিহতদের স্ত্রীরা পড়ে চরম অভাব অনাটনের মধ্যে। স্বামীর ভিটের মায়া ছাড়তে না পারায় আজও তাদের অনেকেই এখানে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। বেঁচে আছেন। তবে দিন যাচ্ছে খেয়ে, না খেয়ে। তাদের মধ্যে শহীদ জ্যোতিন্দ্র মন্ডলের স্ত্রীর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। অতি বৃদ্ধ এই নারী চলৎশক্তিহীন। এরপরও জীবন ধারণের জন্য বাড়িতে বসে হাঁস-মুরগির ডিম কেনা-বেচা করেন। এসব পরিবাবেরর প্রতি আজ পর্যন্ত কারও সুদৃষ্টি পড়েনি। তারা এখনো অপেক্ষায় আছেÑ হয়তো একদিন তাদের খোঁজ নেবে কেউ না কেউ। তারা জানে না তাদের জীবদ্দশায় এ অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কি না।

আব্দুল কাদের : ইনফোলিডার, ডুবুরিয়া ইউডিসি, খুলনা


protik/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন