আড়াইশো বছরেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে নাটোরের কাঁচাগোল্লা

প্রতীক মাহমুদ : ইনফোলিডার, ইউডিসি, নকলা, পিরোজপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৬-০৬ ১৬:৩৯:০৬


কাঁচাগোল্লা
কাঁচাগোল্লা

নাটোরের কাঁচাগোল্লা শুধু একটি মিষ্টির নাম নয়, ইতিহাসের অংশ। আনুমানিক আড়াইশ’ বছর আগে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে মিষ্টি ভোজিদের রসনাতৃপ্ত করে আসছে এই কাঁচাগোল্লা । ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। চিনির রসে ডোবানোর আগে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে, কিন্তু রসগোল্লার ছানাকে তেলে ভেজে চিনির রসে ডোবানো হয়। তাই তার নামকরণ হয়েছে রসগোল্লা। এটা কাঁচা ছানার রসে ডোবানো হয়েছে বলেই এর নাম হলো কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানায়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধÑ যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’ নাটোরের বনলতা সেনের মতোই আলোচিত। বাঙালি ভোজনপ্রিয়, জাতি। আর সে কারণে অতিথি আপ্যায়নেও এর জুড়ি  নেই। খাবারের পরে মিষ্টিতো থাকা চাই-ই। যে কোনো অনুষ্ঠানে অথবা শুভ সংবাদে মিষ্টিমুখ করানোর প্রচলন বাঙালি সমাজে চলে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে। চলছে এখনও। আর সেই মিষ্টি যদি হয় নাটোরের কাঁচাগোল্লা তবে তো সোনায়-সোহাগা। যারা কোনদিন নাটোরের কাঁচাগোল্লার স্বাদ নেননি, তাদের জিভ সব সময় টসটস করে এই অমৃত স্বাদের বিখ্যাত মিষ্টির জন্য। বনলতা সেনের  চেয়েও বেশি রয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার আন্তর্জাতিক পরিচিতি। কাঁচাগোল্লা গোল নয়, লম্বা নয়, আবার কাঁচাও নয়। তবুও নাম তার কাঁচাগোল্লা! এই নামেই এর পরিচিতি  রয়েছে দেশ-বিদেশে। কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনী। জনশ্রুতি আছে, নিতান্ত দায়ে পড়েই নাকি তৈরি করা হয়েছিল এই মিষ্টি। শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দু’মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানিতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনেরজন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! কে বানাবে মিষ্টি? এত ছানা দিয়ে এখন কী হবে? চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তা ভাবনা। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিত এই মিষ্টি বানাতে শুরু করেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা।

কিভাবে কাঁচাগোল্লা তৈরি : খাঁটি দুধের ছানা এবং চিনি কাঁচাগোল্লা  তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে পানির মধ্যে চিনি ঢেলে জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে দিতে হয় সামান্য কাচা দুধ । কড়াইয়ের গাদ ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সাথে কাঠের খন্তা দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যায়। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব। বর্তমানে ভালো কাঁচাগোল্লা তৈরিতে প্রসিদ্ধ শহরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভা-ারের পরিচালক এম, এ, রউফ খান জানান, তারা কাঁচাগোল্লাতে এলাচ ব্যবহার করেন না। এ কারণে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়।

দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লা :  ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সে সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া, প্রভৃতি মিষ্টি ছিল।তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজ পরিবারে পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। ভারতবর্ষের সর্বত্র তো যেতই। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকতা। কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লা : নাটোরের কিছু উল্লেখযোগ্য দোকান ছাড়া এই মিষ্টি নিলে ঠকার সম্ভাবনা রয়েছে। লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান, নীচা বাজারের কু-ু মিষ্টান্ন ভা-ার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভা-ার, স্টেশন বাজারের বনলতা মিষ্টান্ন ভা-ার, ডাবপট্টি মিষ্টান্ন ভা-ার এবং স্টেশন বাজার রেলগেটের জগন্নাথ মিষ্টান্ন ভা-ারে ভালো মানের  কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে সর্বশীর্ষে রয়েছে মৌচাক মিষ্টান্ন ভা-ার। এদের রয়েছে নিজস্ব ৩৮টি গাভী। নিজস্ব জমিতে গো-খাদ্যের জন্য এরা ঘাসও চাষ করে।

কাঁচাগোল্লার দাম : নাটোর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় কাঁচাগোল্লা নিতে কেউই ভুল করেন না। কাঁচাগোল্লার বর্তমান মূল্য মৌচাক মিষ্টান্ন ভা-ারে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। তবে কিছুদিন আগেও নাটোরের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।

* মো. ইসরাইল কবির, ইনফোলিডার, নাটোর


protik/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন