
যশোর জেলার সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়ন। এর অখ্যাত রঘুরামপুর গ্রামে নিরক্ষর অথচ ডিজিটালবোদ্ধা এক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর বসবাস। নাম আক্কেল আলী। সবার আক্কেল চাচা। পেশা ডুয়েল কোর প্রসেসরের মতো। দিনে ভ্যানচালক আর সন্ধ্যায় চায়ের দোকানি। ইউনিয়ন পরিষদ বাজার, যাকে সবাই হাটখোলা নামে চেনে। সেই বাজারেই চাচার দোকান। ভক্তবৃন্দ তার চায়ের দোকানের নাম দিয়েছে এটিএস (আক্কেল টি স্টোর)। সন্ধ্যা হলেই চা পিপাসুরা আক্কেল টি স্টোরে হাজির। বাজারে আরো অনেকের চায়ের দোকান আছে। তবে এটিএসে চা খাওয়ার মজাটাই ভিন্ন। তার আসতে দেরি হলে কেউ না কেউ বাইসাইকেলে করে চাচাকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। এরপর দোকানে ফিরে সাইকেলের কেরিয়ারে বসেই চাচা হাসি মুখে প্রথম বলবে, ‘আরি আল্লা! দেখদিনি কি কা-!’ পানের আতিশয্যে চাচার দাঁতগুলো ব্লাক ডায়মন্ডের মতো সলিড কালার ধারণ করেছে। এক ভক্তের বর্ণনা মতে চাচার দাঁত এত মজবুত যে চানাচুর খেতে গিয়ে শক্ত বাদামের চাপে একটা পড়েও গিয়েছিল। চাচার দোকানে ডিস লাইনের সংযোগ থাকায় বেঁদের মেয়ে জোসনা থেকে শুরু করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি হয়ে আলজাজিরা কিছুই বাদ থাকে না। বারাক ওবামা থেকে মালালাÑ সবাই তার হাতের রিমোটে বন্দি। বাদ মাগরিব থেকে আগ তাহাজ্জদ নামাজ পর্যন্ত চলে চাচার চায়ের বিকিকিনি।
চাচার ব্যবসা এখন অনেক ভালো। সরকার মোবাইলফোনের দাম কমিয়ে দেওয়ায় তিনি একখানা ফোন কিনেছেন। এই মোবাইল ফোনের নাম্বার প্রায় সবার মুখস্থ। এখন আর চাচাকে বাড়ি থেকে সাইকেলে চাপিয়ে আনতে হয় না। মোবাইলে একটা মিস কল দিলেই হলো। চাচা হাজির। এই ফোন কেনার পর থেকে তার ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, আয়ও তেমন বেড়েছে। শুধু চায়ের খদ্দের না, তার ভ্যান গাড়ির যাত্রীরাও তাকে মিস কল দিয়ে থাকে। এ কারণে এখন আর তাকে যাত্রী বা পণ্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ইদানীং তার ব্যস্ততা আর একধাপ বেড়েছে। কারণ তিনি এখন ডিজিটাল। লোকমুখে এ কথা শুনতে পছন্দ করেন, গর্ববোধও করেন। তিনি এখন নানা কারণে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারেও যান।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের একজন উদ্যোক্তা বলেনÑ ডিজিটাল বোদ্ধা আক্কেল চাচা নানা কারণে এখানে আসেন। একদিন এলেন ফ্লেক্সিলোড নিতে। সাধারণত চাচা আসেন নেভি কিংবা ক্যাপেস্টান সিগারেটের খালি প্যাকেটের উল্টো পাশে নাম্বার লিখে নিয়ে। সেদিন দেখি হাতে নতুন মোবাইল। ‘চাচা নতুন মোবাইল কিনেছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই মুখে বিজয়ের হাসি। হ্যায় কিনলাম। বললাম বেশ ভালো কথা। দেশ ডিজিটাল। এখন কি আর বাড়ি গিয়ে ডাকাডাকির দিন আছে। চাচা বলেন, তা যা কইচাও। ২০টে টাকা ভরে দেও দিন। বলি চাচা, কি সেট কিনলেন। চাচার চোখের কোনে খুশির ঝিলিক ‘সবাই কলে রোকিয়া (নোকিয়া) সেট নাই ভালো। তাই নিলাম। সাথে গ্রামীণ সিন (সিম) ফিরি (ফ্রি) পাইছি। সব জাগায় টায়োর (টাওয়ার) পাই। নেটউয়ার (নেটওয়ার্ক) খুব ভালো। কতায় কোন পবলেন (প্রবলেম) নেই।’
এরপর চাচা একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বললাম কি ব্যাপার চাচা, কি হয়েছে? চাচা বলেন, দেখোদিনি মুবালি কি হলো। কেউ কল কল্লি কোন আওয়াজ হচ্ছে না। শুধু গোজরাচ্ছে। সমস্যা শুনেই বুঝলাম চাচার সেটটি হয়ত আন্দাজে চাপাচাপিতে ভাইব্রেশন মুডে চলে গেছে। ভাইব্রেশনের বুমবুম শব্দ চাচার কাছে গোজরানো। এ সব শুনে মনে মনে হাসি পেলেও সামনে হাসতে পারিনি। তিনি অপ্রস্তুত হতে পারেন ভেবে। ডিজিটাল সার্ভিস প্রদানে উদ্যোক্তাদের সাথে এভাবেই গ্রামের আমজনতার গড়ে উঠেছে আত্মিক সম্পর্ক। যে কারণে কিছু হলেই তারা ছুটে আসেন ইউডিসিতে।
চাচা আরেক দিন এসে শুধালেন আচ্ছা তুমাগের একেনে মেমোরি কার্ড পাওয়া যায়? বিনয়ের সুরে জানালাম, চাচা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার খাজা বাবার ভা-ার। কেউ এ জায়গায় আসলে খালি হাতে ফেরে না। সব সেবা পাওয়া যায় এক জায়গায়। চাচা বলেন সেতো আমি জানি। কেউ ডিজিটাল নিয়ে উল্টাপাল্টা কলিই আমি ধরে বসি। সে যাকগে আমারে এট্টা দুই বিঘে মেমোরি দেও দিনি বাপু। দুই বিঘে মেমোরি! সে আবার কি! কান খাড়া করি । ভুল শুনলাম না তো? আবার বলি কি দেব চাচা? এট্টা দুই বিঘে মেমোরি কার্ড দেও। ধন্ধে পড়ে যাই। দুই বিঘে মেমোরি কি? আবার বলি চাচা একটু সাফ করে বলেন তো দুই কি......? চাচা কন আরে বাপুরে দোকানি সব কওয়া কওয়ি কচ্ছিল ১ বিঘা, ২ বিঘা, ৪ বিঘা সাইজের মেমোরি কার্ড পাওয়া যায় বাজারে। আমি সুজাসাপ্টা বিঘা না কয়ে বিঘে কইছি তা তুমি বুঝদি পাচচাও না! অনুমান করি সবাই হয়তো গিগা বলেছে। চাচা বিঘা শুনেছে। জমি পরিমাপের ইউনিট বিঘা। চাচা ভেবেছে মেমোরি কার্ডও হয়তো বিঘায় বিক্রি হয়। মজা করে বলি দুই বিঘায় কি লাগাবেন? চাচা যা বললেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তিনি এসেছেন মেমোরি কার্ড কিনতে, তাতে তিনি গান বা সিনেমা লোড করতে চান না। তার বাসনা, তিনি মেমোরিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি রেকর্ড করে নিয়ে যাবেন। যেটি তিনি শুনাতে চান তার নাতি পুতিদের। এটা বোঝাতে যে একটি ভাষণ কিভাবে একটি জাতিকে বদলে দিতে পারে। আমাদের জাতীয় জীবনে গর্ব করার মতো মহান স্বাধীনতা এনে দিতে কি নির্দেশনা ছিল তা আগামী প্রজন্মকে শোনাতে চান আক্কেল চাচা।
আগ্রহভরে বলি চাচা, এ ভাষণতো বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মাইকেই বাজে। তাহলে আবার নতুন করে রেকর্ড করার কি দরকার? চাচার সপ্রতিভ জবাব, মাইকে যখন বাজে তা কিডা শোনে কও? যার তালে সেই ব্যস্ত। আমরা সেই গ-গোলের (মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়) রেডুয়ায় (রেডিও) কান পাইতে শুনেছি। সেকি আগুন ঝরা কথা। সেই আবেগ কি এখন লোকের আছে? নাতি পুতিগের কয়ে যাব আমি মরে গেলিও জিনিসটা তুরা যতœ করে রাখিস। চাচার আবেগের প্রতি সম্মান করে বলি চাচা, ওরা ইচ্ছা করলেই এটা যখন তখন ম্যানেজ করতে পারবে। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখার কি আছে? চাচা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেনÑ চারিদিকি নকলের ছড়াছড়ি। কবে না আবার ভাষণডাও কেউ জাল করে ফেলে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মেমোরিতে রেকর্ডটি কপি করে দিই।
চাচা যাওয়ার পর ভাবতে থাকি ডিজিটালের ছোঁয়ায় মানুষের ভাবনারও কত পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে মানুষ রিংটোন, গান ছবি বা নাটক লোড দিতে আসতো এখন তারা জীবন-জীবিকার জন্য তথ্য বা ডিভিও কপি করে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কিংবা গণজাগরণের কালজয়ী সব দেশাত্মবোধক গান। উন্নয়ন সূচকে গ্রামের এ সব তথ্য উপাত্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয় কিনা জানা নেইÑ তবে তথ্য প্রযুক্তি যে মানুষের জীবন মানে পরিবর্তন এনেছে আক্কেল চাচারা অবশ্যই তার জীবন্ত সূচক। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল সব সেবার জন্য।
* এস এম আরিফুজ্জামান:ইনফোলিডার, আরবপুর ইউডিসি, যশোর
protik/mohin
মন্তব্য (০)