কুপি থেকে তথ্য প্রযুক্তির আলোয় গ্রামীণ মাতৃত্ব সেবা

প্রতীক মাহমুদ : ইনফোলিডার, ইউডিসি, নকলা, পিরোজপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৬-১০ ১২:৪৮:৩১


seba-1
seba-1

যশোর জেলার সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের অনগ্রসর গ্রাম পাকদিয়া। মুক্তেশ্বরী নদীর তীরঘেঁষা এই গ্রামের দেড় হাজার’ বাসিন্দার বেশিরভাগই মৎস্যজীবী। গ্রামের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে জেলে পল্লী। ‘ভদ্রজনের’ কাছে ওরা মালো, তাই ওদের এলাকা মালোপাড়া নামেই পরিচিত। এ গাঁয়ের গৃহবধূদের জীবনধারা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের আমলের মতই। রাঁধুনী হয়ে জন্ম আর বাবুর্চি হয়ে মৃত্যু। মাঝখানে কয়েকটি সন্তানের জন্মদান আর লালন-পালন। চক্রাকারে ঘোরে জীবনের কক্ষপথ। তবে কখনো কখনো ঘটে এর বিচ্যুতিও। মেয়ে শিশু জন্ম দিলে সেই মা হয়ে যায় অপয়া। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে এর দায়মুক্তির জন্য সংসার ছাড়তে হয় অনেককে। তাতে ক্ষতি কার? প্রবাদ আছে অভাগার মরে গরু আর ভাগ্যবানের মরে বউ। বউয়ের অভাবে ঘর খালি থাকে না। আসে আরেকজন। রেসের ব্যাট যেমন হাত বদল হয় তেমনি সংসারে বদল হয় কুশীলব। শুরু হয় আরেক জীবনের গল্প।

গৌরাঙ্গের সংসারে বউ কল্যাণী সন্তানসম্ভবা। প্রতিনিয়ত হাজার কষ্ট করলেও তার কোনো স্বীকৃতি নেই। পান থেকে চুন খসলেই ‘এটা এখনো হয়নি কেন? সারাদিন করো কি? শুধু খাওয়া আর শোয়া’। ছেলের রুদ্র মূর্তির পালে হাওয়া দেন শাশুড়ি অন্নপূর্ণা। ‘ঘোর কলির যুগ, তাই এই সব অনাচার। আমাদের এ রকম সময় সারাদিন খেটেছি, ছেলেপুলে ঘর গেরস্থ সামলেছি, রাতে ঢেঁকিতে ধান ভেনেছি তবু কোন কাজের ব্যত্যয় ঘটেনি। আর উনি রাজকন্যা; একটু কাজ করলেই হাফসে যান। পরপর দুটি মেয়ে হলো। এবার যদি ভিটেয় বাতি দেবার চেরাগ না হয় দূর করতে হবে আপদ’। গৌরাঙ্গের মতো অলক, সুশান্ত, পরিতোষ, দেবেন, নিতাই, অশোকসহ অন্যদের উদ্দেশে জ্যাঠা-খুড়োরা বলেন, ‘এসময়ে বউয়ের একটু শরীর খারাপ শুনলে হালের চ্যাংড়াদের মুখ শুকিয়ে আমচুর হয়ে যায়। এটা কি কোন মরদের কথা। কথায় আছে ঢোল তবলা আর বৌয়ের পিঠ, না পিটালে চামড়া ঠিক থাকে না। আরে আমরা বিয়ে করেছি বাঁশ ঝাড় লাগিয়ে। বলেছি কথা শুনলে  শোন, না শুনলে কাঁচা কঞ্চির ঘা।’

তাইতো বউদের ব্যাপারে এরা চুপ। শত অসুস্থতায় আসে না বৈদ্য, জোটেনা পথ্য। সন্তানসম্ভবা মা কিংবা প্রসূতির যতœ-আত্তি এ সব তাদের ধাতে ছিল না। গ্রামের নারীদের জীবন ছিল এরকম ফ্রেমে বাঁধা।

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)’র তথ্যপ্রযুক্তি সেবার কল্যাণে অন্যসবের মতো বদলাচ্ছে কল্যাণীদের জীবনের পটভূমি। ইউডিসির উদ্যোগে গ্রামের পূজাম-পের খোলা চত্বরে মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লে ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়। প্রজেক্টরের পর্দায় ভেসে ওঠে জেলা প্রশাসন থেকে সংগৃহীত নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ক ভিডিও চিত্র।

লাইলী নামের একটি মেয়ের কাহিনী। বিয়ে থেকে শুরু করে সন্তান ধারণ, নতুন মুখের আগমন প্রস্তুতি, মায়ের নিয়মিত চেকআপ, নিরাপদ জন্মদান, দু’বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পানসহ সার্বিক বিষয়। সেই সাথে অযতœ-অবহেলায় কিভাবে মা অথবা সন্তানের অথবা দু’য়ের মৃত্যু ঘটে তাও দেখানো হয়। পিন-পতন নীরবতা। কল্যাণী, অঞ্জলি, মুক্তিরা তখন লাইলী বনে গেছে। প্রিয়জনের প্রিয়মুখের অকাল প্রয়াণের কথা কল্পনা করে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে দর্শকচোখ। দজ্জাল শাশুড়ির বিপরীতে মাতৃসম শাশুড়ির রূপ দেখে অন্নপূর্ণাদের কঠিন চোয়াল নমনীয় হতে থাকে। বায়বীয় পরিবর্তন হতে থাকে জ্যাঠা-খুড়োদের। ধারাবহিক দেখানো হয় প্রসবকালীন পাঁচটি বিপদের চিহ্ন। প্রসবপূর্ব প্রস্তুতিতে কি কি করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বিনামূল্যে কি কি সরকারি সেবা পাওয়া যায়। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কি কি সেবা দিচ্ছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে কিভাবে এ সব সেবা গ্রহণ করা যাবে।

ডিসপ্লে শেষ হলে তাদের উচ্ছ্বাসের শেষ থাকে না। বিনোদনের মাঝে শিক্ষার স্বাদটাই যেন ভিন্নতর। মুরব্বিদের উপদেশের চেয়ে উপমা ভালো। তাদের কথার যর্থাথতা প্রমাণ করছে ইউডিসির মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লে ক্যাম্পেইন।

গহীন সমুদ্রে দিকহারা নাবিক যখন দিক হারিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে নিয়তির উপর নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রস্তুতি নেয় শেষ বিদায়ের, তখন নিকশ অন্ধকারে হঠাৎ দেখা দূর বাতিঘরের একচিলতে আলো হয়ে ওঠে নবজীবনের সঞ্জিবনী সুধা। ঠিক তেমনি তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে তথ্য প্রযুক্তির আলো দেখাচ্ছে, না জানার আঁধারে হারিয়ে যাওয়া পথ। তাইতো সারাদেশে প্রতিটি ইউডিসি হয়ে উঠছে এক একটি বাতিঘর। যে বাতিঘরের লাইটম্যানের ভূমিকা পালন করছে ইনফোলিডাররা।

* এস এম আরিফুজ্জামান:ইনফোলিডার, আরবপুর ইউডিসি, যশোর


protik/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন