গ্রামের স্কুল থেকে দেওয়া হচ্ছে নৈতিকতার শিক্ষা। পুরনো নিয়ম ভেঙে ডিজিটাল কায়দায় দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা। মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দেওয়া হচ্ছে এ শিক্ষা। যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিচ্ছে বিশ্বায়নের দ্বারে। শিক্ষার্থীদের সকাল নয়টার মধ্যে স্কুলে আসতে হয়। না হলে স্কুলের মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর ঢোকার সুযোগ থাকে না। স্কুলে এসেই শিক্ষার্থীদের প্রথম কাজ ডিজিটাল হাজিরা দেওয়া। সেটাও কঠিন কিছু নয়। আইডি কার্ডটি মেশিনের সামনে ধরলেই হলো। সংকেত জানিয়ে দেবে, কাজ শেষ। অভিভাবকের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে ক্ষুদে বার্তা। জানিয়ে দেবে আপনার শিশু বিদ্যালয়ে এসে গেছে। ক্লাসে বই ব্যাগ রেখে সবাই হাজির একটি বোর্ডের সামনেÑ যার পরিচিতি তথ্যবোর্ড হিসেবে। এই বোর্ডে প্রতিদিন ঝুলানো থাকে আজকের দিনে কি ঘটেছিল, কোন মনীষীর জন্ম হয়েছিল এই দিনে। এসব তথ্য শিক্ষার্থীরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে শুধু পড়েই না, মুখস্থও করে। কেননা ৯টা ২৫ মিনিটে এ্যাসেম্বলিতে সবার সামনে যে সবচেয়ে নির্ভুলভাবে এ সব তথ্য বলতে পারবে সে ম্যান অফ দ্যা ডে’র আদলে পাবে আজকের শিশু কার্ডটি। তার মানে ওই দিনে স্কুলের সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সেরা বলে পরিগণিত হবে সে।
এটি বাইরের দেশের কোন স্কুলের গল্প নয়। ‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া’র মতো সামনে পা বাড়ালেই মিলবে শিক্ষার সাথে ভালো মানুষ গড়ার কারখানা এই বিদ্যাপীঠ। অজ পাড়াগাঁয়ে থেকেও আন্তর্জাতিক মানে পাঠদানে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্বমহিমায় বিকশিত।
অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি থাকে প্রার্থনা। সব ধর্মের শিশুরা পর্যায়ক্রমে সামনে এসে প্রার্থনার বাণী পাঠ করে। অন্য সব স্কুলেও শিক্ষার্থীরা শপথ পাঠ করে। কিন্তু এখানে আছে ভিন্নতা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে শপথ পড়েন শিক্ষকরাও। হাত প্রসারিত করে শিক্ষার্থীদের সামনে প্রতিদিন শপথ নেন এই বলে, ‘আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে শপথ করছি যে, আমি শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি শিষ্টাচার ও নৈতিকতা চর্চা এবং মানবিক গুণাবলিসহ শিক্ষার্থীদের একজন সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকবো। বিদ্যালয়ের সুশৃঙ্খল পরিবেশ ও পরিচ্ছনতা বজায় রাখবো। সময়ের প্রতি সচেতন থাকবো। সহকর্মীদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করবো। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুগত থেকে দেশ ও সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন করবো। শিক্ষার্থীদের প্রতি সম আচরণ এবং তাদের আপন ¯েœহে গড়ে তুলবো’।
অ্যাসেম্বলি শেষে সারিবদ্ধভাবে ঢুকতে হয় ক্লাসে। শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ডিজিটালের ছোঁয়ায় প্রতিটি শ্রেণীতে আছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সুবিধা। পাশপাশি আছে প্রতিটি ক্লাসে সিসি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ। প্রধান শিক্ষক যেমন অফিস রুমে বসে প্রতিটি ক্লাস দেখতে পান তেমনি ‘ক্লাউডস অ্যাপসে’ ইচ্ছা করলে বাড়ি বসে অথবা বিশ্বের যে কোন স্থান থেকে মনিটরিং করা যাবে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক কি পাঠদান করাচ্ছেন। দুপুর ১টা ১৫ থেকে ১টা ৫৫ মি: পর্যন্ত টিফিন বিরতি। এখানে ঘটে মজার ব্যাপার। স্কুলের ভেতরেই একটি খাবারের দোকান আছে। দোকানের নাম সততা দোকান বা ‘অনেস্টি শপ’। সেখানে চকলেট, চানাচুর, বিস্কুটসহ নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী থাকে। তবে থাকে না কোন দোকানি। প্রতিটি পণ্যের গায়ে মূল্য লেখা থাকে। শিক্ষার্থীরা যে যে পণ্য কেনে, নির্ধারিত ক্যাশ বাক্সে সেই দাম রেখে চলে আসে। কেউ কারো প্রতি খেয়াল রাখে না, তবু নেই ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা। ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে চালু হওয়া ‘অনেস্টি শপে’ এখনো একটি টাকার কিংবা একটি পণ্যের হিসাবে গরমিল হয় নি। এও কি সম্ভব ! বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই অনেস্টি শপের পাশেই চোখে পড়বে একটি দেয়াল, তাতে হ্যাঙ্গার টানানো। দেয়ালে লেখা মহানুভবতার দেয়াল। কি হয় এই দেয়ালে? কেনই বা এর নাম মহানুভবতার দেয়াল? কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা সমান নয়। অনেক শিক্ষার্থীর যেখানে চাহিদার তুলনায় অঢেল আছে তেমনি অনেকের প্রয়োজনই মেটানোর সামর্থ্য নেই। অস্বচ্ছল বন্ধুটির পাশে দাঁড়িয়ে যায় স্বচ্ছল আরেক বন্ধু। যার যে জিনিসটি অতিরিক্ত আছে, ব্যবহার করে না, বাড়িতে পড়ে আছে সে এসে এই হ্যাঙ্গারে সেই জিনিসটা রেখে যায়। আর যার নেই সে এসে হ্যাঙ্গার থেকে নিয়ে যায়। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে চলছে দেওয়া-নেওয়ার এ কাজটি। তবে এর কোনো রেকর্ড থাকে না কে দিচ্ছে আর কে নিচ্ছে। দাতা-গ্রহীতার তথ্য গোপন রাখার পেছনের কারণ কেউ যেন কাউকে মানসিকভাবে আঘাত না করে।
এসব তথ্য বর্ণনার সময় এই স্বপ্নীল বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের চোখে ছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাস। ওরা গর্বিত এমন একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পেরে। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সজীব আহমেদ, শাহরিয়ার রেজা সাজিদ, তিথী বিশ্বাস আর কাজী আতিয়া আদিবা এভাবেই বলছিল তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে।
যশোর-মাগুরা মহাসড়কের আড়পাড়া বাজার থেকে হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেকের পথও নয়। প্রাচীরঘেরা স্কুলের মেইন গেট দিয়ে সামনে ঢুকলেই চোখে পড়বে প্রকা- এক বটবৃক্ষ। বিদ্যালয়ের প্রতীক হিসেবে যেন বটগাছের অবস্থান। বামে আছে শ্বেতপাথরে বাঁধানো বাংলাদেশের মানচিত্র। ডানে আছে অভিভাবক আনন্দ পাঠাগার। পাঠাগার পেরিয়ে সামনে গেলে দেয়ালে ঝোলানো তথ্য বোর্ড। তার সামনে গুণীজন গ্যালারি। সেখানে রবীন্দ্র-নজরুল জসিম কিংবা জয়নুলের ছবিই নয়, আছে এলাকার গুণীজনদের ছবিও। পরের দেয়ালটি জুড়ে আছে আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা। জাতীয় ব্যক্তিত্ব ও নানা দৃশ্য সংবলিত প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ।
নান্দনিক এই সব উদ্যোগের পেছনের মানুষটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। তিনি জানান, ২০১১ সালের জুন মাসে বিদ্যালয়টিতে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই ইচ্ছা ছিল সন্তানসম শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা এবং আদর্শে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেই থেকে এই আলোকিত কার্যক্রমের যাত্রা শুরু। স্কুলের ভাঙা প্রাচীর সংস্কার হয়ে দু’পাশে গেট লাগানো হলো যাতে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না হয়। আবার কোন শিক্ষার্থী যেন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে ঘুরতে না পারে। এই কৌশলের পরে তিনি ভাবেন কোন কৌশলে শিশুদের নীতি-নৈতিকতা, সততা, মহানুভবতা, পরোপকারিতা শেখাবেন। সেই ভাবনা থেকেই অনেস্টি শপ আর মহানুভবতার দেয়ালের জন্ম। এর আগে যে সব অভিভাবক বাচ্চাদের নিয়ে এসে অলস সময় গল্প গুজবে কাটান তাদের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন অভিভাবক আনন্দ পাঠাগার। এখানকার ব্যবস্থাপনায় আছে অভিভাবক কমিটি। তারা শুধু বই’ই পড়েন না স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকেই শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন সন্তানদের। এর ফলে যেমন শিক্ষক-অভিভাবক আন্তরিকতা বাড়ছে তেমিন ছুটি বা ট্রেনিংয়ে থাকলে শিক্ষক সংকটে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে না। শিশুদের উৎসাহ প্রদানে তিনি যেমন চালু করেছেন আজকের শিশু কার্ড প্রদান, তেমনি আছে আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা। প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার জানান, একদিন তিনি অফিস রুমে বসে আছেন। বাইরে তার চোখে পড়লো বৃষ্টি¯œাত মাঠে একজন বৃদ্ধ পিছলে পড়ার উপক্রম। ততক্ষণাৎ একজন শিক্ষার্থী দৌড়ে এসে বৃদ্ধের হাত ধরলো। স্বজনের মমতায় মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় এগিয়ে দিলো ওই বৃদ্ধকে। তিনি এ দৃশ্য ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি করেন। তখন থেকে চালু হলো আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা। ভালো কোন আচরণ করলে সেই ছবি উঠিয়ে ঝুলানো হয় সংগ্রশালার দেয়ালে। অন্যদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতেই এই আয়োজন। তিনি গর্বের সাথে জানান, বিদ্যালয়ের সকল অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। ৬ শতাধিক শিক্ষার্থীর এই বিদ্যালয়ে আছে মিড ডে মিলের সুবিধা, কাবিং কার্যক্রম এমনকি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও ড্রেসকোড। প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগ দেন সহ-শিক্ষক দীপংকর বিশ্বাস। তিনি জানান, বাঙালি ঐতিহ্য আর ডিজিটালের মিশেলে চলছে বিদ্যালয়টি। অচিরেই শুরু হবে অনলাইন স্কুল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। স্কুল চত্বরে থাকবে ‘ওয়াই ফাই’ সুবিধা, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারে বসবে অল ইন অল কম্পিউটারসহ আরো নানা উদ্যোগ। এ সব কথা যখন তারা বলছিলেন তখন তাদের চোখের সীমানা দূর ভবিষ্যৎপানে।
এই সব নন্দিত উদ্যোগের সহযাত্রী মাগুরা জেলা প্রশাসক মুহঃ মাহবুবর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। তিনি বলেন, মাগুরা জেলা প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতা আর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহায়তায় বিদ্যালয়টি এতটা পথ এসেছে।
শালিখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মমিন উদ্দিন বিদ্যালয়টি সম্পর্কে বলেন, আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসব শিক্ষণীয় উদ্যোগ উপজেলার শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, মাধ্যমিকসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতা শিক্ষাদানে এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিদ্যালয়টিকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফিল্ড ভিজিট করানোর মাধ্যমেও এ উদ্যোগটি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারের একান্ত ইচ্ছা, প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণে সবাই সুইজারল্যান্ডে যান সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা দেখতে, তিনি আমরণ চেষ্টা করে যাবেন এই বিদ্যাপীঠকে সেই লেভেলে নিয়ে যেতেÑ যেন সবাই সুইজারল্যান্ড না গিয়ে আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখতে আসেন। ভালো মানুষ গড়ার সুতিকাগার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খ্যাতি আড়পাড়া, শালিখা, মাগুরা ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বেÑ এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
*মুক্তি খান:ইনফোলিডার, বুনাগাঁতি ইউডিসি, শালিখা, মাগুরা
protik/mohin
মন্তব্য (০)