নাটোরের উত্তরা গণভবন

প্রতীক মাহমুদ : ইনফোলিডার, ইউডিসি, নকলা, পিরোজপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৬-১০ ১৫:৩৪:৫২


নাটোরের উত্তরা গণভবন বলে খ্যাত প্রাসাদ
নাটোরের উত্তরা গণভবন বলে খ্যাত প্রাসাদ

মো. ইসরাইল কবির

ঢাকার বাইরে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র বাসভবন নাটোরের উত্তরা গণভবন। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ নামকরণ করেন। এরপর থেকেই নিরাপত্তাজনিত কারণে উত্তরা গণভবনে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। স্থানীয় জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর জনসাধারণের জন্য উš§ুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই প্রতিদিনি দূর-দূরান্তের মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে নটোরের উত্তরা গণভবন।

জানা যায়, দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম ছিলেন নাটোরের রানী ভবানীর নায়েব। রানী ভবানী দয়ারামকে এতো বিশ্বাস করতেন যে, রানীর পক্ষে দয়ারাম গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাক্ষর করতেন। রানী দয়ারামের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দিঘাপতিয়া পরগনার জমিদারী উপহার দেন। ১৭৩৪ সালে প্রায় ৪২ একর জমির উপর দয়ারাম রায় স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন দিঘাপতিয়া রাজপ্রসাদটি নির্মাণ করেন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজাগণ ১৭১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এখানে ।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় সব বয়সী মানুষ।  এর দৃষ্টিনন্দন মূল ফটকের উপরে রয়েছে ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা বিশালাকার ঘড়ি, যা এখনো সঠিক সময় দিচ্ছে এবং আছে বিশাল আকার ঘণ্টা, যার ধ্বনি এখনও বহুদূর থেকে শোনা যায়। প্রতি বুধবার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন চাবি ঘোরান। এমনিভাবেই চলছে বছরের পর বছর ধরে।  চারিদিকে সুউচ্চ প্রচীর ও সুগভীর পরিখা পরিবেষ্টিত রাজবাড়ির ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, কাছারি ভবন, তিনটি কর্তারানী বাড়ি, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্যালেসের দক্ষিণে রয়েছে ইতালিয়ান গার্ডেন, যাতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মূল্যবান মার্বেল পাথরে কারুকাজ করা ভাস্কর্য। দেশি-বিদেশি নানা জাতের শোভা বর্ধনকারী গাছ। ভাস্কর্যগুলো একটা পাথরখ- কেটে তৈরি। অত্যন্ত নিপুণ হাতের কারুকাজ। মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে যায়। পরিখাগুলোতে ফোটে বিভিন্ন জাতের শাপলা, পদ্ম। প্রধান ভবনের সামনে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের নির্মিত দুটি কামানসহ রাজবাড়িতে মোট ছয়টি কামান রয়েছে। মূল রাজপ্রসাদে প্রবেশের পথে সিঁড়ির দু’পাশে দুটি কৃষ্ণমূর্তি ছিল। দর্শনার্থীর অসতর্কতায় একটি ভেঙে যাওয়ার পর অপরটি ভবনের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ গণভবনের বিভিন্ন স্থানে গোপন ক্যামেরা স্থাপন করে ২০১২ সালে ২৫ অক্টোবর জনপ্রতি ১০টাকা প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উš§ুক্ত করা হয়। পরে প্রবেশমূল্য বাড়িয়ে জনপ্রতি ২০ টাকা করা হয়। তবে ইতালিয়ান গার্টেন এবং ভবনের ভেতরের অংশ দেখতে আগেভাগেই জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। টিকিট চালুর পর থেকেই দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে উত্তরা গণভবনের আঙিনা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনার্থীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করে যান গণভবনের অপার সৌন্দর্য। গাইবান্ধা থেকে বেড়াতে আসা নুরে শাহী লাবলু জানান, গণভবনের ছায়াঘেরা অপার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত তিনি। তিনি সুযোগ পেলেই বার বার এখানে আসার ইচ্ছা পোষণ করেন । দর্শনার্থী আইনুন্নাহার আঁখি বলেন, গণভবনকে ঘিরে নাটোরে পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সেজন্য এর আশপাশে হোটেল-মোটেল গড়ে তোলা জরুরি। স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, দর্শক আকৃষ্ট করতে লেকগুলোতে বোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গণভবনের পাশে ভালো মানের কোনো হোটেল নির্মাণ করা গেলে ভ্রমণ পিপাসুদের সুবিধা হবে। স্থানীয় বাসিন্দা ডন শিকদার বলেন, ২০ টাকা  দিয়ে  টিকিট কেটেও ইতালিয়ান গার্ডেনসহ প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। ইতিহাস জানতে সবকিছু উš§ুক্ত করে দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে একটি জাদুঘর করার কথা বলেন তিনি।

নাটোরের সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন ‘জেগে ওঠো’র সমন্বয়ক নাজমুল হাসান বলেন, গণভবনের সামনের জায়গায় বেশ বিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এগুলো সরিয়ে গণভবনের জায়গা দখলমুক্ত করা দরকার। গণভবন হলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। সেই সাথে ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটা রক্ষা করা অতীব জরুরি।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসেবে সেই সাথে ‘দ্য সিটি অফ কুইন’ হিসেবে পরিচিত করে তুলতে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই গণভবন আরও দৃষ্টিনন্দন করতে কাজ শুরু করা হয়েছে। উত্তরা গণভবনে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে যাতে মন্ত্রিসভার বৈঠক করানো যায়, সে বিষয়ে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নাটোরে আগত দর্শনার্থীরা সহজেই শহরে রাত যাপন করে মাদ্রাসা মোড় থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে এই গণভবন দেখতে যেতে পারেন। নাটোরে পাঁচতারা মানের কোনো হোটেল না থাকলেও রাত যাপনের জন্য মাঝারিমানের বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। এখানে ৩০০ থেকে ১  হাজার ২০০ টাকায় রাতযাপন করা যায়।

* মো. ইসরাইল কবির: ইনফোলিডার, হালসা ইউডিসি, নাটোর


protik/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন