মুক্তাঞ্চলে একমাত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ‘হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়’

মোমেনীন : ইনফোলিডার, বাগাট ইউডিসি, মধুখালী , ফরিদপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৭-০৮ ১৬:২৫:৪৫


মুক্তাঞ্চলে একমাত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ‘হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়’
মুক্তাঞ্চলে একমাত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ‘হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়’

মো. শাহীনুর ইসলাম, ইনফোলিডার, বুড়িমারী ইউডিসি, লালমনিরহাট

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল এই প্রতিষ্ঠানে। মুক্তবাংলার মাটিতে এটিই ছিল একমাত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার। এখান থেকে তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার এয়ার ভাইস মার্শাল এম খাদেমুল বাশারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এলাকার সংগ্রামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা বাউরা থেকে বুড়িমারী পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বাউরায় শক্ত ডিফেন্স গড়ে তোলায় পাক-হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বুড়িমরী অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে সমগ্র রংপুর জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে ৬ নং সেক্টর গঠিত হয়। রংপুর ও দিনাজপুরের ইপিআর, বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ৬নং সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার ৬ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারের দায়িত্বে ছিলেন। প্রথমদিকে নিয়মিত ও অনিয়মিতসহ প্রায় দুই হাজার সৈন্য ছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজার। এই সেক্টরে ৫টি সাব-সেক্টার ছিল, সাব সেক্টরগুলো হলোÑ ১. ভোজনপুর সাব-সেক্টর-কমান্ডার নজরুল এবং পরে স্কোয়ার্ডন লিডার সদর উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ২. পাটগ্রাম ও বড়খাতা সাব-সেক্টরে প্রথমে ইপিআর’র জুনিয়র কমিশন অফিসার সুবেদার বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বে কমান্ড পরিচালিত হয়। পরে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন ৩. সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন ৪. মোঘলহাট সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টন দেলোয়ার ও ৫. চিলাহাটিতে-ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ইকবাল দায়িত্ব পালন করেন। এই ৬নং সেক্টরের সদস্যরা পাটগ্রাম উপজেলাকে ৯ মাস শত্রু মুক্ত রাখার বীরত্ব দেখান। আবেদ আলী এমপি প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। মতিউর রহমান জোনাল চেয়াম্যান এবং জোনাল সেক্রেটারি হিসাবে ভারতের কুচবিহারে দায়িত্ব পালন করেন, সিদ্দিক হোসেন এমপি দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতায় মুক্তিযোদ্ধাাদের ট্রেনিংয়ের জন্য একটি ক্যাম্প পরিচালনা করেন।
বুড়িমারী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম (সাবেক পুলিশ অফিসার) বলেন, ‘আমি যুদ্ধের সময় লালমনিরহাট ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিলাম। ওই সময় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের চ্যাংড়াবান্দায় আবেদ আলী এমপি’র সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে দল গঠন করে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর আমি ২০-৩০ জন সহপাঠী নিয়ে যাই এবং ভারতের মুজিবনগরে ট্রেনিং গ্রহণ করি। ট্রেনিং শেষে ৬নং সেক্টরের ৬নং কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি। আমরা এই বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় তথা ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারের আওতায় যুদ্ধ করে অনেক কিছু পেয়েছি। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের দাবি জানাই।মুক্তাঞ্চলে একমাত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ‘হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়’
৮ নং বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত রহমান বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর কাহিনী শুনেছি, অনেক যন্ত্রণা, নির্যাতন সয়ে দীর্ঘ নয় মাস কাটিয়েছে এ দেশের মানুষ। এ সময় একমাত্র ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার মুক্তাঞ্চলে ছিল। এ কারণে যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, লাল সবুজের পতাকায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। কারণ এই স্কুলেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার। মুক্তিযুদ্ধকালে ১১টি সেক্টরের ১০টিই ছিল বাংলাদেশের বাইরে। কেবল ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল মুক্তবাংলায়। আর তার অবস্থান ছিল বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজারিত এই স্কুলটির প্রতি কারও নজর নেই। মুক্তিযুদ্ধের এই মূল্যবান স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা দরকার।
হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলাম। স্কুলটিতে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এম খাদেমুল বাশারারের চেয়ার, টেবিল ছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের লোক এসে তা নিয়ে গেছে। আমার মতে এগুলো ফেরত নিয়ে এসে এখানে সংরক্ষণ করা উচিত। কারণ আমাদের ছেলেমেয়েরা এটা দেখার জন্য ঢাকায় যেতে পারবে না।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম বলেন- মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ৬নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হিসাবে খ্যাত হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এখানেই আমি আজ প্রধান শিক্ষক হিসাবে চাকরি করছি। এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে। সরকারের কাছে আমাদের সকলের দাবি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করা হোক।


momenin/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন