মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিবিসি বাজার ও কাশেম মোল্লার রেডিও

মোমেনীন : ইনফোলিডার, বাগাট ইউডিসি, মধুখালী , ফরিদপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৭-১৯ ১৩:২০:১৪


মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিবিসি বাজার ও কাশেম মোল্লার রেডিও
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিবিসি বাজার ও কাশেম মোল্লার রেডিও

মো. শরিফুল ইসলাম খান, ইনফোলিডার, আতাইকুলা ইউডিসি, পাবনা

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বছরে। পাক সেনারা নিজেদের স্বার্থে ক্যাম্প বসিয়েছে পাবনার পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায়। পেপার মিল থেকে দক্ষিণ দিকে গ্রামটি। এ গ্রামেরই বাসিন্দা কাশেম মোল্লা। তিনি পড়লোখা করেছেন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। পাকশী রেল বাজারে তার একটি মুদি দোকান ছিল। ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানি আর্মি বাজার পুড়িয়ে দিলে, তিনি চলে যান নিজ গ্রাম পাকশীর রূপপুরে। বাড়িতে লাগান একটি কড়ই গাছ। গাছের পাশে খোলেন চায়ের দোকান। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, দেশের কোথায় কি হচ্ছে কেউ জানে না। মুক্তিসেনারা থাকত নির্দেশনার অপেক্ষায়। কখন কি খবর আসে- কিন্তু সেই খবর তারা কিভাবে পেতে পারে। তার ব্যবস্থা ছিল তখন সব সমস্যা দূর করে দেন কাসেম মেল্লা একটি তিন ব্যান্ডের রেডি ছিল তার। এসময় সবাই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত।

কাশেম মোল্লা তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের অনুরোধে থ্রি ব্যান্ডের রেডিওটি কিনেছিলেন। সে সময় পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একটি রেডিও পাওয়া যেত না। আর থ্রি ব্যান্ড রেডিওর মালিক হওয়া তো ভিন্ন কথা। চায়ের দোকানে ভিড় জমানোর জন্য রেডিওটি দোকানে নিয়ে যেতেন। পরে গ্রামে গড়ে তোলা দোকানেও নিয়ে আসতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ লাগার পর দেশের অবস্থা নিয়ে বিবিসি বাংলায় খবর প্রচারিত হত। বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, সংক্ষেপে -বিবিসি। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের বাসিন্দাদের অতিপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু বিবিসি নামে যে একটি বাজার হতে পারে সেটি অনেকেই ধারণায় ছিল না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে এই বাজার গড়ে ওঠে। ইতিহাসের গৌরবময় স্মৃতি ধারণ করে এটি সগর্বে টিকে আছে। ইতমধ্যে যথেষ্ট বিস্তারও ঘটেছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিবিসি বাজার ও কাশেম মোল্লার রেডিও

মুক্তিযোদ্ধারা খবর শোনার জন্য কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে ভিড় করত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ছিল অসীম মমত্ববোধ। তিনিও চাইতেন অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মুক্তিযোদ্ধারাই তাকে তাকে বলত ‘আপনিওতো মুক্তিযুদ্ধে আছেন। অস্ত্র নিয়ে যারা যুদ্ধ করছে তারাই কেবল মুক্তিযোদ্ধা নয়, আপনার মতো যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা।’ মুক্তিযুদ্ধকালে পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আশংকা উপেক্ষা করে কাশেম মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিসি, আকাশবাণী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শোনাতেন। আশপাশের এলাকায় মানুষও দু’বেলা নিয়মিত ভিড় জমাতো তার চায়ের দোকানে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে। চা খেতে আসা নানান লোকের নানা কথা জমা থাকত কাশেম মোল্লার কাছে। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশীয় দোসর, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পর্কে তথ্য দিতেন কাশেম মোল্লা। অনেক সময় রেডিওতে খবর পরিবেশন হয়ে যাওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে ফিরলে তিনি তাদের তা হুবহু বলে শোনাতেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে হঠাৎ একদিন রাজাকারদের কাছে খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। প্রথমে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। এরপর বলে, ‘তোম এধার আও, তোমহারা দোকানমে রেডিও বাজতা হায়, শালে তুমকো খতম করদেগা, তুমহারা রেডিও নিকালো।’ সেনাদের কথায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন কাশেম মোল্লা। ভেবেছিলেন, ‘মাইরে ফেলবি’। তিনি বলেন, ‘ও চিজ হামারা নেহি হায়, আদমি লোক খবর শুনলেকে লিয়ে লেকে আতা হায়, বাদমে চলে যাতা হায়।’

কাশেমের কথায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে পাকসেনা। রাইফেলের বাট দিয়ে তার পায়ে উপর্যুপরি আঘাত করে তারা। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশেম মোল্লার পা অকেজো ছিল। খুঁড়িয়ে হাঁটতেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালে সন্ধ্যা হলেই রূপপুর গ্রামে হাঁকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলত, চল ‘বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবে কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসি খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরো অনেক দোকান। যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরবর্তী সময়ে বিবিসি বাজার নামে পরিচিতি লাভ করে।

পরবর্তী সময়ে উৎসাহী কয়েক ব্যক্তি লন্ডনে চিঠি লিখে বিবিসি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানায়। একথা জেনে ১৯৯২ সালে বিবিসি’র পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের একটি টিম বাংলাদেশে এসে কাশেম মোল্লার সাক্ষাৎকার নেন। উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি শ্রোতাদের সাথে আলাপ করা। তারা পরিদর্শন করেন বিবিসি বাজার। এসেছিলেন বিবিসির সেদিনের ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন প্রধান ভ্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান, ভাষ্যকার দীপঙ্কর ঘোষ এবং বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ সংবাদ দাতা আতাউস সামাদ।

সিরাজুর রহমান কাশেম মোল্লার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। তিনি লন্ডন থেকে কাশেম মোল্লার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েক’টি চিঠি পাঠান। কিন্তু সেগুলো একাধিক হাত ঘুরে কাশেম মোল্লার কাছে আর পৌঁছেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও তার খবর কেউ আর রাখেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি আবুল কাশেম মোল্লা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তিনি দুঃখও করেছেন। না পাওয়ার বেদনা নিয়েই তিনি চলে গেছেন ফেরার দেশে। সেই বিবিসি বাজার এখন সরকারি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও গৌরব নিয়ে তার নিজহাতে লাগানো সেই কড়ই গাছ বেশ মোটাতাজা হয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নিয়ে।

বিবিসি বাজার আজ সুপরিচিত হলেও দেশের অনেকেই জানে না এর জন্মের কথা। জানে না বিবিসি বাজার গড়ে ওঠার পিছনে কাশেম মোল্লার অবদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কিংবা বিবিসি’র অনুষ্ঠান শোনা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, সেসময় মহা বিপর্যয়ের কথা জেনেও ভরা বাজারে বসে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে শুনিয়েছেন খবর এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান, দেশাত্মবোধক গান এবং চরমপত্রসহ নানা কথিকা ও নাটক। কাশেম মোল্লা নেই। রয়েছে তার কড়ইগাছ আর বিবিসি বাজার।

কাশেম মোল্লার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তার ভাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারাই তাকে বলেছিলেন, আপনিও মুক্তিযোদ্ধা। সামান্য সরকারি সহায়তা পেয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ৫০ হাজার টাকা। সেই রেডিও এখনো যত্ন করে রাখা আছে কাশেম মোল্লার আলমারিতে। সেটি নষ্ট হয়ে গেছে ২০ বছর আগে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সেই রেডিও সংরক্ষণ করা যেতে পারে জাতীয় জাদুঘরে।


momenin/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন