যশোরে জনপ্রিয় হচ্ছে বারোমাসি তরমুজ চাষ

মোমেনীন : ইনফোলিডার, বাগাট ইউডিসি, মধুখালী , ফরিদপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৭-২৪ ১২:৩২:০৩


যশোরে জনপ্রিয় হচ্ছে বারোমাসি তরমুজ চাষ
যশোরে জনপ্রিয় হচ্ছে বারোমাসি তরমুজ চাষ

এস এম আরিফুজ্জামান, ইনফোলিডার, আরবপুর ইউডিসি, যশোর

যশোরের মাঠে মাঠে এখন জেসমিন আর ব্লাক প্রিন্সের সমারোহ। সুগন্ধী ভেবে কেউ ভুল করতে পারেন। তবে জেসমিন আর ব্লাক প্রিন্সের সুরভীতে মেতেছে যশোরের চাষিরা। দূর থেকে দেখলে মনে হতে মাচায় মিষ্টি কুমড়া ঝুলে আছে। দেখতে কুমড়ার মতো মনে হলেও আসলে তা তরমুজ। মাঠের পর মাঠ চাষ হচ্ছে জেসমিন আর ব্লাক প্রিন্স জাতের বারোমাসি তরমুজ। মাটি থেকে অল্প উঁচু মাচায় শত শত ঝুলন্ত তরমুজে ভরে গেছে ক্ষেত। অসময়ের ফলনে দামও মিলছে ভালো। তাইতো দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতে মাচার তরমুজের সাথে দুলছে এ অঞ্চলের কৃষকের সুখস্বপ্ন। এ স্বপ্নের যাত্রা শুরু রহেলপুর গ্রামের ছেলে তরিকুলের হাত ধরে।

যশোর সদর উপজেলার রহেলাপুরের কৃষক তরিকুল ইসলাম। সবার কাছে এখন তার পরিচিতি সফল তরমুজ চাষি হিসাবে। নিজ প্রচেষ্টায় কৃষক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন কৃষি উদ্যোক্তা । নিজ উদ্যোগে নতুন চাষিদের তরমুজ চাষে দিচ্ছেন হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। গড়ে তুলেছেন সরদার ট্রেডার্স নামে কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্র। যেখানে মিলছে তরমুজ চাষের বীজ, সারসহ নানান উপকরণ। অনেকের কাছে তিনি এখন দৃষ্টান্ত। যশোর সদর উপজেলার রহেলাপুর, পাঁচবাড়ীয়া, উসমানপুর, জগমোহনপুর আর কাশিমপুরের বিভিন্ন মাঠে মাচায় উৎপাদিত হচ্ছে বারোমাসি তরমুজ।

যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম রহেলাপুর। গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের মেজ ছেলে তরিকুল ইসলাম। ১৯৯৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর লেখাপড়া আর এগোয়নি। জীবিকার প্রয়োজনে এক সময় পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। কাজ করতেন কুয়ালালামপুরে ক্লাসিক সাইনিক মোল্ডিং ফ্যাক্টরিতে। সেখানে মেশিনের সাহায্যে কাঠ দিয়ে তৈরি হতো ফটোফ্রেম। অটো ফটোফ্রেম তৈরির মেশিন অপরাটের ছিলেন তরিকুল। বিদেশ বসে ফটোফ্রেম বানালেও তাঁর হৃদয়ের ফ্রেমে ছিল স্বদেশের ছবি। রহেলাপুর গ্রামের শৈশব স্মৃতি তাকে আবেগ তাড়িত করতো। তাই আট বছর মালয়েশিয়ায় কাটিয়ে ২০১৪ সালে গ্রামে ফেরেন তরিকুল। গ্রামে ফিরে দেশের জন্য কোনো কিছু করার তাড়না অনুভব করতে থাকেন তরিকুল। সময়টা ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। তরিকুল তার বড়ভাই খায়রুল ইসলামের কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গা বেড়াতে গিয়ে বারোমাসি তরমুজ চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হন। মাঠে তরমুজের বীজ বপনের আগে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়ে যায় তরিকুলের হৃদয়ে। চুয়াডাঙ্গায় তরমুজ চাষ হলে যশোরে কেন নয়? একটি প্রতিষ্ঠিত বীজ কোম্পনির বিপণন কর্মকর্তা বড়ভাই খায়রুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় নেমে পড়েন তরমুজ চাষে। চুয়াডাঙ্গায় চায়না ও জাপানি জাতের তরমুজ উৎপাদন হলেও তরিকুল ভিন্নজাত উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু করেন তাইওয়ানের বীজ জেসমিন টু আর ব্লাক প্রিন্স জাতের তরমুজ চাষ। এর পর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন সদর উপজেলার রহেলাপুর, পাঁচবাড়ীয়া, উসমানপুর, জগমোহনপুর আর কাশিমপুরের জনা চল্লিশেক কৃষক। বর্তমানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ একর জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে বারোমাসি তরমুজ। তরিকুল এখন সবার কাছে পাচ্ছেন তরমুজ চাষে আইকনের সম্মান।

যশোরে মাচা পদ্ধতিতে বারোমাসি তরমুজ চাষ বিবেচিত হচ্ছে সম্ভাবনাময় একটি কৃষিপণ্য হিসাবে। তরিকুল জানান, এই তরমুজের জীবনকাল মাত্র ৬০ দিনের। ১ বিঘা জমির জন্য প্রয়োজন ৫০ গ্রাম বীজ। যার দাম ৩ হাজার ৮’শ টাকা। বিঘাপ্রতি সেড তৈরির মালসিং পেপার ৭ হাজার ৫’শ, মাচা পদ্ধতিতে শেড তৈরির বাঁশ আর মজুরি খরচ ১০ হাজার, সার মাটি আর বালাই নাশক স্প্রে বাবদ ৭ হাজার ৫’শ, পরিচর্যা বাবদ ৬ হাজার, পরিবহন খরচ ২ হাজার। বিঘাপ্রতি তরমুজ চাষে সর্বমোট খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে ৬০ দিনে উৎপাদন হয় ১২’শ থেকে ১৫’শ টি তরমুজ, যার ওজন প্রায় ৪ থেকে ৪.৫ মেট্রিকটন। প্রতিটি তরমুজ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলে যার বিক্রি মূল্য হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি লাভ থাকে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। যা তুলনামূলক অন্যান্য ফসলের চাইতে অনেক লাভজনক।

তরিকুল আরও জানান, একটি সেড তৈরি হলে সেই শেডে নুন্যতম তিনবার তরমুজের আবাদ করা যায়। ফলে এই খরচটি পরের দু’বার হয় না। ফলে পরের দু’বার উৎপাদন খরচ কমে গিয়ে লাভ আরও বেশি হয়।

যশোরে তরমুজ চাষের সম্ভাবনা নিয়ে সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু ছায়েদ মো. আরিফ জানান, সাধারণত দেশে ফাল্গুন চৈত্র মাসে তরমুজের চাষ হয়ে থাকে। এই তরমুজই যশোরের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করে বিক্রি করেন। সিজনের বাইরে এখন আর সেই তরমুজ বাজারে নেই। কিন্তু বারোমাসই এই তরমুজ পাওয়া যায় বলে এর চাহিদা বেশি। তাইওয়ানের জেসমিন-১, জেসমিন-২ ও ব্লাক প্রিন্স জাতের তরমুজে পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলক বলে ফসলে মার খাওয়ার ঝুঁকিও কম। গাছের গোড়ায় জলাবদ্ধতা ছাড়া এই জাতের উৎপাদন ব্যাহত হবার আর কোনো কারণ নেই। এই তরমুজ অনেক সুস্বাদু, পুষ্টিকর।

তিনি জানান, আশার কথা হচ্ছে বোরো ধান কাটার পর প্রায় দু’ আড়াই মাস জমি পতিত থাকে। দু’টি ধান চাষের মাঝে অনায়াসে একবার তরমুজের ফলন সম্ভব। এর ফলে জমির সঠিক ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি আয়ও বৃদ্ধি পাবে। এ সব কারণে যশোরে দিন দিন তরমুজ চাষির সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বাড়ছে কৃষি জমিও। ধান ও সবজির পাশাপাশি এ অঞ্চলে বারোমাসি তরমুজ হয়ে উঠছে একটি জনপ্রিয় কৃষিপণ্য।


momenin/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন