শহীদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি চান চুকনগরের সুন্দরী বালা

মো: আব্দুল কাদের বিশ্বাস : ইনফোলিডার, ডুমুরিয়া ইউডিসি, ডুমুরিয়া, খুলনা
প্রকাশ কাল : ২০১৭-০৯-০৯ ১৩:৪৪:৪৭


শহীদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি চান চুকনগরের সুন্দরী বালা
শহীদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি চান চুকনগরের সুন্দরী বালা

১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। বিনিময়ে হারিয়েছি ৩০ লাখ মানুষের জীবন আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের ইতিহাস সময়ের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এলেও এখনও আড়ালে রয়ে গেছে অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা। এমনই একটি ঘটনা এখনও স্থান পায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তালিকায়। ৩০ লাখ শহীদের ভেতর এমনও এক পরিবারের সদস্যরা ছিলেন, যাদের একমাত্র দুগ্ধপোষ্য শিশু বাদে সবাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন।
ঘটনাটি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর গ্রামে। চুকনগর নিয়ে অনেক কিছু লেখা হলেও রাজকন্যা সুন্দরী বালার জীবনকাহিনী এখন পর্যন্ত অনেকেরই অজানা। রাজকন্যা সুন্দরী বালা সেই শিশুÑ যে চুকনগর হত্যাকা-ের সময় মৃত মায়ের বুকের ওপর বসে দুধপান করেছিল। ওই গণহত্যায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে প্রাণ দিলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় দুগ্ধপোষ্য শিশু সুন্দরী বালা। বর্তমানে কেমন আছেন সেদিনের সেই সুন্দরী বালা? কি করছেন তিনি?- এবার জানব তাঁর কথা।
চুকনগর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি গ্রাম। খুলনা থেকে এর (চুকনগর) দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার। ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত বলে খুব সহজেই যোগাযোগ করা যেত চুকনগরে। উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগর বাজারটি মুক্তিযুদ্ধকালে খুব যাঁকজমকপূর্ণ ছিল। এটি সাতক্ষীরা এলাকার ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় ওই সময়ে এই পথ দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে জমায়েত হয়েছিল চুকনগরে। এদের মধ্যে কারও উদ্দেশ্য ছিল ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া আর কারও উদ্দেশ্য ছিল সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। ওই সময় সেখানে উপস্থিত হয়েছিল বটিয়াঘাটা, বাগেরহাট, দাকোপ, সাতক্ষীরাসহ দেশের বহু এলাকার মানুষ। উপস্থিতির মধ্যে অধিকাংশই ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ঠিক এমন সময় পাকিস্তানি পিশাচ বাহিনী চালাচ্ছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। খুলনা শহর থেকে মালবাহী দুটি ট্রাকে এক প্লাটুন পাকবাহিনী এসে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চালায় এ হত্যাযজ্ঞ। তাদের বিরামহীন গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কয়েক হাজার মানুষের দেহ। চুকনগর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শোকাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ। বিধাবা হয় সহ¯্র নারী। সন্তান হারা হয় হাজারো মা-বাবা। বাবা-মা হারা হয় অনেক সন্তান। চারদিকে মৃতের স্বজনদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় নিরীহ বাঙালির লাশ পড়ে ১০ হাজার। সৃষ্টি হয় নারকীয় নতুন এক ইতিহাস। অনেক লাশ তারা ভাসিয়ে দেয় ভদ্রার পানিতে। আবার অনেককে নিয়ে যায় ট্রাকে করে। এর পরও পড়ে থাকে কয়েক হাজার মৃতদেহ।
পড়ে থাকা ওই মৃতদেহগুলোর ভেতর হঠাৎ-ই শিশুর চিৎকার। মৃত এক মায়ের বুকের ওপর তাঁর ছয় মাসের শিশু দুধপান করছে। এমন কুরুক্ষেত্রে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া ওই অবুঝ শিশু জানে না তার মা-বাবা আর নেই। কোথায় যাবে শিশুটি? কে নেবে তার লালন-পালনের ভার? উপায় না দেখে এলাকাবাসী শিশুটিকে উদ্ধার করে সংখ্যালঘু এক পরিবারের হাতে তুলে দেন। ওই পরিবারের মা-বাবার ওপর পড়ে তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব। তারাই হয়ে ওঠেন তাঁর পালিত মা-বাবা। পালিত বাবার নাম মাদার দাস এবং মা মালঞ্চ দাসি। পরে তারা শিশুটির নাম রাখেন রাজকুমারী সুন্দরী বালা।
সুন্দরীর পালিত মা-বাবা জনান, আমরা গরিব হওয়া সত্ত্বেও সুন্দরী বালাকে বড় করেছি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে আমরা যা খেয়েছি ওকেও তাই খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। বর্তমানে খুলনা জেলা প্রশাসন সুন্দরীকে একটি চাকরি দিয়েছে। ওই চাকরি করেই কোনোভাবে বেঁচে আছে মেয়েটি।
সুন্দরী বালা জানান, মৃতপুরী থেকে ফিরে সেই ছয় মাস বয়স থেকে বহুকষ্টে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছি। জন্ম থেকে কষ্টের মধ্যেই কাটছে আমার জীবন। যখন কষ্টের ভার আর সইতে পারছিলাম নাÑ ঠিক সেই মুহূর্তে খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডুমুরিয়া শিল্পকলা একাডেমিতে আমার একটি চাকরি হয়। এর আগে আমাকে ইটভাটায় কাজ করতে হতো।
প্রশাসনের এ বদান্যতার কথা উল্লেখ করে সুন্দরী বলেন, এখন আর আমাকে ইটভাটায় কাজ করতে হয় না। জীবন ক্ষয় করতে হয় না। এখন আর আগের সেই চরম কষ্টের জীবন নেই। তবে দুঃখের জীবন যাদেরÑ তাদের সুখ স্থায়ী হয় না। আমার ডান পাশের মাজার হাড় ক্ষয়ে গেছে। কাজ করতে খুবই কষ্ট হয়। আমি আমার পূর্ণ পরিচয় জানি না। শুধু জানি, আমি একজন মানুষ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে আমার জন্ম। মা-বাবা আমার কি নাম রেখেছিলেন জানি না। আমার পালিত মা-বাবা আমার নাম রেখেছেন রাজকন্যা সুন্দরী বালা।
সুন্দরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছরেও আমি শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। এটা শুধু জানি, আমি শহীদ পরিবারের সন্তান। কিন্তু সরকারি কোনো প্রমাণ নেই। শহীদের সন্তান হিসেবেই আমি বাঁচতে চাই। তবেই আমার মৃত মা-বাবার আত্মা শান্তি পাবে। যারা আমাকে লালন-পালন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারাও শান্তি পাবেন। আমি শহীদের সন্তান, শহীদ পরিবারের সন্তানÑ এই স্বীকৃতি চাই।


Md Abdul Kader Biswas/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন