শিক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্যেও অনন্য মেটি স্কুল

মোঃ শামীম : ইনফোলিডার, ইউডিসি, বিরল, দিনাজপুর
প্রকাশ কাল : ২০১৭-১০-০৬ ২২:২৮:৫৯


শিক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্যেও অনন্য দিনাজপুরের মেটি স্কুল
শিক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্যেও অনন্য দিনাজপুরের মেটি স্কুল

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রাম এখন জমজমাট। দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী এবং পর্যটক আসছে একটি স্কুলে। অথচ মাত্র ১৫ বছর আগেও এখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামই ছিল না। ছেলে-মেয়েদের চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে গিয়ে পড়াশোনা করতে হতো অন্য কোনো গ্রামে। বলতে গেলে রুদ্রপুর একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রাম। অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সঙ্কট এবং উদ্যোগের অভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কেউ কারও সাথে শলা-পরামর্শ করার সুযোগও পাননি। তবে আজ আর সেই রুদ্রপুর আগের মতো নেই। এখানে এখন শিক্ষার আলো জ্বলছে অহর্নিশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি স্কুলই জ্বালিয়েছে সেই শিক্ষার আলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম ‘মেটিস্কুল’।
এলাকায় শিক্ষা গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা যখন হিমশিম খাচ্ছিলেনÑ ঠিক তখনই দ্বীপশিখা নামের স্বেচ্ছাসেবী একটি প্রতিষ্ঠান এলাকাবাসীর পাশে এশে দাঁড়ায়। সমর্থন জানায় অভিভাবক এবং বিদ্যাপিপাসু শিক্ষার্থীরা। দ্বীপশিখার অর্থায়নে আর গ্রামবাসীর সমর্থনে ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর গড়ে ওঠে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় মেটিস্কুল। দীর্ঘদিন পরে হলেও আশা পূরণ হয় প্রান্তিক এ গ্রামবাসীর। প্রাথমিক পর্যায়ে এ স্কুলে শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো নাচ-গান-অভিনয় ও চিত্রাঙ্কন। এখানে দলীয় আলোচনাও শেখানো হতো। পাশাপাশি চর্চা চলতো কথোপকথন-ভিত্তিক ইংরেজি শিক্ষার। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজও শেখানো হতো। এখন আর মেটি স্কুল শুধু ওই শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে মেটিতে শিশুশ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলছে। সাথে সাথে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। স্কুলটি যেহেতু স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন করে দিয়েছে, সেহেতু এর নামের সাথে ওই সংগঠনের সম্পর্ক রাখা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয়েছে ‘মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’। সংক্ষেপে মেটি স্কুল।
১৯৯৯ সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু হলেও প্রায় সাত বছর পর সেটি নতুনভাবে গড়ে ওঠে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির একটি দাতা সংস্থার অনুদানে ব্যতিক্রমি নির্মাণ কৌশলে এর মাটির ঘর তৈরি করা হয়। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীগণ স্কুলের নির্মাণকাজে অবদান রাখেন। এতে সহযোগিতা করেন দ্বীপশিখার কর্মীরা। কাজের তত্ত্বাবধান করেন জার্মান আর্কিটেক্ট আন্না জিয়ারিংগার এবং আইকে রোওয়ার্গ। মাটির তৈরি মেটি স্কুল ছয় কক্ষবিশিষ্ট। দোতলা এ ভবনটির আয়তন আট হাজার বর্গফুট। এর নির্মণকাজে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৭ লাখ টাকা। ইট-রড-সিমেন্ট এবং মোটা বালু দিয়ে নির্মাণ করলে এর খরচ পড়ত কোটি টাকার ওপরে। এর প্রধান নির্মাণসামগ্রী হলো কাদামাটি আর ধানের খড়। ভবনের দেয়ালে যাতে ফাটল না ধরে সেজন্যই এ উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বাঁশ-কাঠ-ইট-সিমেন্ট-রডও ব্যবহার করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে দেয়ালে দাগ না পড়ে সেজন্য এই খড় ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালের ভিতের ওপর দেওয়া হয়েছে আর্দ্রতারোধক। যে কারণে মাটির নিচের আর্দ্রতায় কোনো ক্ষতি হবে না। দেয়ালের পলেস্তরায় আছে মাটি ও বালু। মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে পামতেল ও সাবানের পেস্ট। এতে পানিবাহিত সমস্যা থেকে বাঁচবে ভবনটি।
স্কুল ভবনের নয় ফুট ওপরে প্রথম তলার ছাদ হিসেবে বাঁশ দিয়ে তার ওপর চাটাই বিছিয়ে আবারণ তৈরি করা হয়েছে। দোতলার ছাদে ১০ ফুট ওপরে বাঁশ এবং কাঠ মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু বৃষ্টির পানি প্রতিরোধে ওপরে দেওয়া হয়েছে টিন। মেটি স্কুল নির্মাণে যাদের মেধা ও মানসিক পরিশ্রম রয়েছে তারা হলেন জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার ১০ জন এবং স্থানীয় ১৯ জন শ্রমিক। ২০০৭ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থাপত্যের সাথে বাংলাদেশের মেটি স্কুলও আগাখান অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। পুরস্কার হিসেবে দ্বীপশিক্ষা ১৩ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার, আর্কিটেক্ট আন্না হিয়ারিগো ১৬ হাজার ৫০০ ডলার এবং আর্কিটেক্ট আইকে রোওয়ার্গ ৮ হাজার ২০০ ডলার লাভ করেন।
মেটি স্কুলে বিদেশিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও নিতে পারে মেধার পুরস্কার। সে জন্য স্কুলটিতে অধিকসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হওয়া দরকার এবং প্রতিযোগিতায় উঠে আসা দরকার।


shamim99/mohin

মন্তব্য  (০)

মন্তব্য করুন