এস এম আরিফুজ্জামান, ইনফোলিডার, আরবপুর ইউডিসি, যশোর
‘জরুরী ভিত্তিতে নামজারী করার জন্য এ কার্যালয়ে কোন আবেদন বা তদবীর গৃহীত হয় না’। উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঝুলানো এমন একটি নোটিশ দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন যশোর সদর উপজেলার খোলাডাঙ্গা গ্রামের ফিরোজ গাজী। তিনি গিয়েছিলেন নামজারী কেসের আবেদনের জন্য। নামজারী করার জন্য এই অফিসে যদি আবেদন বা তদবীর না করা হয় তাহলে কোথা থেকে এ সব করা যায় ভেবে চিন্তিত ছিলেন তিনি। কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মকর্তার। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন ভূমি অফিস থেকে আবেদন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এই আবেদন করা যাবে স্ব স্ব ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টার থেকে। আর তদবীর ! চেষ্টা করাতো দূরে থাক সে কথা উচ্চারণ করাও মানা। কোনো সুযোগ নেই এখন, সব অনলাইন। এমনটাই অনুরণিত হচ্ছে যশোর সদর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
উপজেলা ভূমি অফিস থেকে ফিরে ফিরোজ গাজী চলে আসেন সেবা প্রদানে নিজ এলাকার বাড়ীর পাশের আরশীনগর হয়ে থাকা আরবপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে। সেখানে বসে করেন ৪৯ নং ভেকুটিয়া মৌজার আর এস খতিয়ান ৮৯৫,আর এস ৩৯৮১ দাগের ৪ শতক জমির নামপত্তনের আবেদন। ১৬৩৪৫ কোড নাম্বার থেকে এস এম এসে তিনি জানতে পারেন তার অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন। সেই সঙ্গে জেনে যান তার অনলাইন আবেদন নাম্বার। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ সেবা পেয়ে উচ্ছ্বসিত তিনি। সহজ হয়ে যাওয়া সেবা প্রদান পদ্ধতির প্রণেতা সদর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা। তার পরিকল্পনা আর কিছু শুভ উদ্যোগে বদলে যাচ্ছে নড়াইল কাচারীরর দীর্ঘদিনের সেবা প্রদানের চালচিত্র।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) হিসাবে যোগদান করেন সৈয়দ জাকির হাসান। ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু করেন স্বপ্নের পথে পদযাত্রা। মিশন একটাই ই-মিউটেশন। আবেদন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে অনলাইন পদ্ধতি চালু করা। কাজটা বলা যত সহজ করা ততটা সহজ নয়। ভূমি অফিস মানে দুর্নীতির আঁতুড় ঘর। সেখানে ঘাটে ঘাটে অপেক্ষমান মধ্যস্বত্তভোগীরা। স্যারের সাথে হট লাইন অথবা সহজে করিয়ে দেওয়ার টোপ গিলিয়ে পকেট খালি করার দক্ষ লোকের আনাগোনা। বাইরের এ সব লোকের সঙ্গে আছে অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যতা। দীর্ঘদিনের গড়ে উঠা সে সখ্যতার দেয়াল ভাঙা আর সুবিধাবাদীদের পদচারণা সরিয়ে ভূমি সেবা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে তিনি দৃঢ়পণ হয়ে শুরু করেন কর্মযজ্ঞ। নিজের অফিসে বন্ধ করে দেন আবেদন গ্রহণ। সব আবেদন হবে তৃণমূল থেকে। যাতে সেবা গ্রহিতাকে কষ্ট করে উপজেলা ভূমি অফিসে আসতে না হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমি সংস্কার বোর্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত ই-মিউটেশন সেবা চালুকরণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপকেই তিনি দৃশ্যমান করেছেন নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগে। এখন নামজারীর জন্য সেবা গ্রহিতাকে চারটি ধাপ পার হতে হচ্ছে। প্রথমত ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে আবেদন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে অনলাইন আবেদন ও নথিপত্র যাচ্ছে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রতিবেদনের জন্য। ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে প্রতিবেদন হয়ে সহকারী কমিশনারের কাছে যাচ্ছে শুনানির জন্য। শুনানি শেষে সোনালী ব্যাংক বাজার শাখায় চলতি হিসাব নাম্বার ২৩১৬৮০২০০০৪২৮ এ সরকার প্রদত্ত ফি ১১৫০ টাকা জমা দেয়া শেষ ধাপ। ৪টি ধাপের জন্য সেবা গ্রহিতা টেলিটক থেকে ১৬৩৪৫ কোড নাম্বার থেকে পাবেন ৪টি এসএমএস। যাতে থাকছে পরবর্তী করণীয় সর্ম্পকে নির্দেশনা।
যশোর সদরের ১৫টি ইউনিয়ন, ১৩টি তহশীল আর ২শ’৪৭টি মৌজা নিয়ে যশোর সদর উপজেলা ভূমি অফিস। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ২ হাজার ৬শ’য়ের অধিক আবেদন পেয়েছেন যার মধ্যে নিষ্পত্তি করেছেন ১ হাজার ৪’শতাধিক। অচিরেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় বাদবাকী গুলো প্রসেসিংয়ে আছে।
সৈয়দ জাকির হাসান যশোর সদর উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসাবে যোগদানের পরের দিন ই-মিউটেশন চালু করেন। প্রথমে তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ে আবেদন নিশ্চিত করেন। এরপর তিনি ১৫ দিনের মধ্যে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন নিশ্চিত করেন। সর্বশেষ ২৫-৩০ দিনের মধ্যে নামপত্তন তিনি নিশ্চিত করেছেন। পূর্বে যেখানে একটি আবেদনের শুনানি পড়ত ৩-৫ মাস পর। বর্তমানে শুনানি এবং প্রতিবেদন প্রদানে লাগছে ২০-৩০ দিন। নিষ্পত্তি সবোর্চ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে।
অনলাইনে ই-মিউটেশন আবেদন বিষয়ে দেড়ায়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সমীর কুমার ঘোষ বলেন, নামজারীর অনলাইন আবেদন সেবাটি ইউডিসিতে আসায় এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সেবা নিশ্চিত হয়েছে। সাধারণ নাগরিক সহজেই গ্রামে বসেই আবেদন করতে পাচ্ছে মাত্র ২শ’৫০ টাকায়। প্রতিদিন গড়ে তিন চারটি আবেদন আসছে। সেবা সহজীকরণের পাশাপাশি আগের তুলনায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সেবা ও আয় বেড়েছে।
অনলাইন নামজারী আবেদনের বাইরেও সৈয়দ জাকির হাসান সদর উপজেলা ভূমি অফিসকে সেবা বান্ধব করতে নিয়েছেন নানা নান্দনিক উদ্যোগ। তার অন্যতম হচ্ছে নেজারতের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে কর্মচারীদের বেতন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান, ডিসিআরের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান, বিভিন্ন বরাদ্দ সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনা নীতি যথাযথ অনুসরন। খাস জমি নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকারের নামে রেকর্ডভূক্ত জমিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং রেকর্ড হালকরণ সম্পন্ন। ইতোমধ্যে যার সুফল মিলেছে। বকচর মৌজায় ৩ কোটি টাকার মূল্যের জমিতে অবৈধ কাজ বন্ধ করেছেন তিনি। চালু করেছেন ফ্রন্টডেস্ক সেবা। একটি ফ্রন্টডেস্ক একটি রেজিস্টার। ভূমিবিষয়ক সকল পরামর্শ নিশ্চিতকরণে রেজিস্টারে অর্ন্তভূক্ত সকল অভিযোগ পরবর্তীতে ফোনের মাধ্যমে ফিডব্যাক গ্রহণ ও সমাধান করছেন তিনি। গণশুনানি এবং বিবিধ মামলার শুনানির জন্য অফিসের দ্বিতীয় তলায় এজলাসসহ বসার সু-ব্যবস্থা করেছেন। সরকারি সার্ভেয়ার দিয়ে সকল ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের স্কেচম্যাপ তৈরি এবং জমির সঠিক নক্সা প্রণয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও উপকরণ প্রদান করেছেন তিনি, যা দেশে সর্বপ্রথম। অফিসের সম্মুখে গোলঘরের কাজ সম্পন্ন প্রায়। সেখানে মাস খানেক পরেই বসবে অন্যরকম একটি বৈঠক। সপ্তাহে একদিন উঠোন বৈঠকের আদলে তৃণমূল মানুষের সাথে বসানো হবে ভূমিসেবা সংক্রান্ত বৈঠক। জরিপ, রেকর্ড, খাজনা থেকে শুরু করে আলাপ চারিতার মাধ্যমে শেখানো হবে ভূমি সংক্রান্ত সকল সেবাপ্রাপ্তির নিয়ম আর আইন কানুন। নিরাপত্তার জন্য অফিস বাউন্ডারির জন্য টেন্ডার আহবান করেছেন। পুরাতন পরিত্যক্ত নড়াইল কাচারি আধুনিক রুপে রুপায়নের জন্য পরিত্যক্ত ভবন ও পুরাতন গাছ অপসারনের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমান আছে। অচিরেই এর কাজ শুরু হবে। অভিযোগ,পরামর্শ অথবা তথ্যের জন্য www.jessore.acland.gov.bd যোগাযোগ করা যাচ্ছে অনায়াসে।
এ বিষয়ে যশোর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, ৪টি ধাপে ই-মিউটেশন কার্যক্রমটি চলমান রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ভূমি কর্মকর্তা ও ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। আবেদনকারীর ২টি ধাপ ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্পন্ন হওয়ায় ভোগান্তি প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করতে সময় লাগছে ৩-৫ দিন। সুতরাং মানুষকে তার সর্বোচ্চ সেবাটি স্বল্প সময়ে প্রদান করা যাচ্ছে ই-মিউটেশন চালুর মাধ্যমে। এখন আর শহরে এসে দালালের খপ্পরে পড়ে ভুয়া পর্চা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মিসকেস কমে যাচ্ছে। কমে গেছে ভোগান্তি।
এক সময় সেবার জন্য মানুষকে ঘুরতে হতো সেবার পিছনে আর ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে সেবা এখন দোরগোড়ায় ঘোরে মানুষের জন্য। তথ্যপ্রযুক্তির খেয়ায় চেপে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ যশোর সদর উপজেলা ভূমি অফিস তার অনন্য দৃষ্টান্ত।
mohin/mohin
মন্তব্য (০)