Logo

গবাদিপশু পালনে ভাগ্য ফিরল ফিরোজার

momenin , ফরিদপুর || প্রকাশ কাল : 2017-07-13 15:53:22


মো. মনোয়ার হোসেন, ইনফোলিডার, ফুলছড়ি ইউডিসি, গাইবান্ধা

জীবন সংগ্রামী নারী ফিরোজা বেগম। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, ধানের গোলা, গরু-ছাগলের গোয়াল, নগদ টাকা সবই ছিল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের করালগ্রাসে বসতবাড়ীসহ ফসলি জমি চলে গেলে হঠাৎই নিঃস্ব হয় পড়েন ফিরোজা। রাতারাতি রাজরাণী থেকে ভিখারিনীতে পরিণত হন। শুরু হয় অভাব অনটন। এ সময় স্বামীর একার দিনমজুরের আয়ে সংসার চালাতে হতো। তবে সব হারালেও কখনও মনোবল হারাননি ফিরোজা। নতুন করে বাঁচার আশায় শুরু করেন গবাদিপশু পালন। এ কাজে তার সহায় হয় স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। বর্তমানে ফলও পাচ্ছেন তিনি।
ফিরোজা বেগমের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের চর কালাসোনা গ্রামে। স্বামীর নাম আব্দুল মজিদ। বসতবাড়িসহ ৬ বিঘা জমি ছিল তাদের। ২০১১ সালের বন্যার শেষ ভাগে ব্রহ্মপুত্র নদের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যায় বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব ফিরোজা বেগম স্বামী সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেন পার্শ্ববর্তী মামা শ্বশুরের বাড়ির আঙিনায়। স্বামী আব্দুল মজিদ দিনমজুরের কাজ করে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ফিরোজা বেগম নিজে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। সিদ্ধান্ত নেন দাদির কাছ থেকে শেখা গবাদিপশুর বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাকে কাজে লাগিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করবেন। এ কাজে তাকে সাহায্য করে বেসরকারি সংস্থা ‘বারসিক’। প্রথমে তিনি পাঁচটি ছাগল ও একটি গরু কেনেন। এক বছর পর ওই গরু-ছাগল বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা পান। তা থেকে সংসারে সাত হাজার টাকা ব্যয় করেন। বাকি টাকায় আবারো নয়টি ছাগল ও দুটি গরু কেনেন। ছাগল-গরুগুলো এখন বেশ মোটাতাজা হয়েছে। এবার তিনি মোটা অংকের টাকা পাওয়ার আশা করছেন।
ফিরোজা বেগম জানান, চরাঞ্চলে শীতের সময় ছাগলসহ গৃহপালিত সব পশু-পাখিরই বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। ছাগলের রোগের প্রকোপ থাকে বেশি। রোগ প্রতিরোধে তিনি সঠিক ব্যবস্থা নেয়ায় তার ছাগলের রোগ হয়নি। কিভাবে তিনি ছাগলের পরিচর্যা করেন জানতে চাইলে বলেন, কাঁশি ও পাতলা পায়খানা রোগ বেশি হয় চরের ছাগলগুলোর। এ তিনটি রোগের চিকিৎসা তিনি নিজে করে থাকেন। কাঁশি হলে এক লিটার গরম পানির সাথে ৩-৪ ফোটা কেরোসিন ও ৩-৪ চা-চামচ পরিমাণ লবণ মিশিয়ে খাওয়ান। হাঁপানি হলে ছাগল জোরে জোরে শ্বাস টানে। শ্বাস নেয়ার সময় শব্দ হয়। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। খাওয়া কমিয়ে দেয় ও ঝিম ধরে থাকে। শরীরের লোম সব খাড়া হয়ে যায়। নাকের আশপাশ শুকিয়ে যায়। এ রোগ হলে কাঁচা হলুদ প্রথমে চাকা চাকা করে কেটে হলুদের সাথে ৮-১০ গ্রাম লবণ মাখিয়ে আক্রান্ত ছাগলকে দিনে তিনবার খাওয়াতে হয়। এছাড়া এক লিটার গরম পানির সাথে ৫-৬ ফোঁটা কেরোসিন তেল মিশিয়ে দিনে দু’বার দিতে হয়। আক্রান্ত ছাগলকে ছয় থেকে সাত দিন এভাবে খাওয়ানো হলে হাঁপানি ভালো হয়ে যায়।
অপরদিকে ছাগলের পাতলা পায়খানা হলে খাওয়া কমে যায়। পেটব্যথা করে বলে ছাগলের অস্থির ভাব লক্ষ্য করা যায়। বার বার পানির মতো পায়খানা করে। অতিরিক্ত পায়খানা করার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ রোগ হলে ভাটির পাতা থেতলা করে ৫০ গ্রাম রস করে ১০০ গ্রাম পরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে দিনে তিনবার খাওয়াতে হয়। এইভাবে ৩-৪ দিন খাওয়ালেই পাতলা পায়খানা ভালো হয়ে যায়। ছাগলের পায়খানা যদি অতিরিক্ত পাতলা হয় এবং বার বার হয় তাহলে ভাটি ও মটমটি পাতার ৫০ গ্রাম রসের সাথে ২৫ গ্রাম পরিমাণ কাঁচা যাউন ও ১০-১৫ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দুই থেকে তিন দিন খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
কালাসোনা চরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা বারসিকের কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, ফিরোজা বেগমের মতো চরাঞ্চলের অনেক গৃহবধূই অন্যান্য কাজের পাশাপাশি পশু পালনের সাথে জড়িত। এভাবে তারা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করতে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। তারাও জানেন ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কিভাবে গবাদিপশুর চিকিৎসা করতে হয়। এ স্থানীয় জ্ঞান তারা ধরে রেখেছেন নিজেদের প্রয়োজনেই। আর এভাবেই আদিকাল থেকে আজ অবধি মানুষের যাপিত জীবনের নানা প্রয়োজনে লুকায়িত জ্ঞানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সম্প্রসারিত হয়ে আসছে।

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি
Developed by