গাইবান্ধা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা-বালাসী সড়ক ঘেঁষে কাঁটাতারে ঘেরা বিস্তীর্ণ সবুজ একটি মাঠ। এর এক পাশে বড় একটি ফটক। আরেক পাশ দিয়ে চলে গেছে মেঠোপথ।বাইরে থেকে দেখলে বিস্তীর্ণ মাঠটিকে মনে হতে পারে কোনো কৃষিজমি। কিন্তু এই মাঠের ভিতরেই লুকিয়ে আছে অনন্য এক স্থাপনা। আর কৌতূহলীএ স্থাপনার নাম ‘ফেন্ডশিপ সেন্টার’।পুরো ভবনটি দৃষ্টির আড়ালে। কারণ আধুনিক এই স্থাপত্যটি গড়ে উঠেছে মাটির নিচে।
একাধিক ব্লকে বিভক্ত এই ভবনটির আয়তন ৩২ হাজার বর্গফুট। এতে রয়েছে প্রশিক্ষণ খেলাধুলা ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। রয়েছে একটির সঙ্গে আরেকটির সংযুক্ত বারান্দা এবং খোলা প্যাভিলিয়ন।গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামে অবস্থিত এই ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি। এটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়। সংস্থাটি চরের মানুষের জন্য কাজ করে।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি স্থাপত্য শিল্পে এক অনবদ্য সৃষ্টি। যা শুধু গাইবান্ধা বা আমাদের দেশকে নয় অবাক করেছে বিশ্বকে। ফলে মিলেছে একাধিক বিদেশি অ্যাওয়ার্ড। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি সম্পূর্ণ মাটির নিচে অবস্থিত। অর্থাৎ ভবনের ছাদ ভূমি সমতলে। ছাদে লাগানো হয়েছে নানা জাতের ঘাস। ওপর দিক থেকে দেখলে মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ছবি ফুটে ওঠে অনেকটা। যা দেখে স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ অভিভূত হবেন। এই ভবনে চলে দাপ্তরিক নানা কর্মকাণ্ড। রয়েছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ভেতরের সবকিছু দৃষ্টিনন্দন।
২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর মদনেরপাড়া গ্রামে প্রায় আটবিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ‘আরবান কন্সট্রাকশন’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় আনুমানিক আট কোটি টাকা। সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। এখানে রয়েছে দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মধ্যে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কেন্দ্র দুটিতে একসঙ্গে ২০০ জন প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আবাসিক কক্ষ রয়েছে ২৪টি। আবাসিক কক্ষগুলোর মধ্যে শীতাতপ পাঁচটি। কক্ষগুলোতে মোট ৫০ জন লোক থাকতে পারবেন। সেন্টারে রয়েছে উন্নত খাবার ব্যবস্থা। পানি নিষ্কাশনের জন্য রয়েছে পাঁচটি নর্দমা। যারা আবাসিকে থাকবেন, তাদের জন্য রয়েছে অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা ও বই পড়ার লাইব্রেরি। এখানে প্রতিদিন কেরাম, দাবা ও ব্যাডমিন্টন খেলা চলে। লাইব্রেরিতে আছে পাঁচ শতাধিক বই। সেন্টারে রয়েছে আধুনিক ইন্টারনেট সুবিধা ও উন্নতমানের মিউজিক সিস্টেমএবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর। বিদ্যুৎ না থাকলে নিজস্ব জেনারেটরের ব্যবস্থাও রয়েছে। সুন্দর স্থাপত্য নির্মাণের জন্য ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি ২০১২ সালে ‘এআরপ্লাসডি অ্যাওয়ার্ড’ পায়। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্স রিভিউ এই পুরস্কার দেয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ‘আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’ পেয়েছেন ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) এই পুরস্কার প্রদান করে থাকে।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার সম্পর্কে স্থপতি কাসেফ মাহবুব চৌধুরী জানান, যেখানে এটি নির্মাণ করা হয়েছে সেই জায়গাটি ছিল নিচু। মাটি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করতে গেলে বাজেটের ৬০ শতাংশই শেষ হয়ে যেত। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান গ্রামে হওয়ায় সেখানে দোতলা ভবন করলে গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে মিলত না। তাই সমতল ভূমির সঙ্গে মিল রেখে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
কাসেফ মাহবুব আরও জানান, তিনি এই ভবনের নকশা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বৌদ্ধবিহারের ধারণা থেকে। ভবনটি ওপরের দিক থেকে দেখলে অনেকটা মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ছবি ফুটে ওঠে।
মদনেরপাড়া গ্রামেরকলেজ শিক্ষক মেরাজ আলী বলেন, ‘নদীভাঙন কবলিত প্রত্যন্ত এই এলাকায় এমন ব্যতিক্রম একটিস্থাপনা এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়েদিয়েছে।বাইরে থেকে অনেক লোক প্রতিদিন ভবন টিদেখতে আসেন।ফলে এলাকাটি পর্যটনের জন্য উপযোগী হয়ে উঠছে।’
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২৫ দিনই সেন্টারের নিজস্ব কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে। স্থানীয়ভাবে তৈরি ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই ভীড় করে হাজারো দর্শনার্থী।